বিশেষ প্রতিনিধি:
সোমবার অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে ভারতের শেয়ারবাজার বন্ধ রাখা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলো অর্ধদিবসের জন্য খোলা ছিল। ভারতজুড়ে পার্টির আয়োজন করা হয়। লাখ লাখ ভারতীয়র চোখ ছিল একটি কর্মসূচিতে– অযোধ্যায় হিন্দু দেবতা রামমন্দিরের উদ্বোধন। সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্দিরটি উদ্বোধন করতে পুরোহিতদের সঙ্গে যোগ দেন। এ কর্মসূচি মার্চ থেকে মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে, তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির ফের নির্বাচিত হওয়ার প্রচারণার সূচনা হিসেবে কাজ করছে।
রামমন্দিরের দায়িত্বে থাকা ট্রাস্ট আনুমানিক ৭ হাজার মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেখানে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, তারকা খেলোয়াড় ও অন্য ব্যক্তিরা ছিলেন। নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার রামমন্দির উদ্বোধন কর্মসূচিকে জাতীয় উদযাপন হিসেবে তুলে ধরেছে। যদিও এ মন্দিরের ইতিহাসকে অনেকে আধুনিক ভারতের অন্ধকার অধ্যায়গুলোর অন্যতম বলে অভিহিত করেছেন। এটি দেশের রাজনীতিকে ভিন্নরূপ দিয়েছে এবং সমাজে গভীর ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করেছে। এ মন্দিরের স্থানের সঙ্গে নিপীড়নের ইতিহাস যুক্ত। সে কারণেই এটি ঘিরে এত বিতর্ক।
রামমন্দির স্থাপনের পেছনে বিতর্ক কী?
মন্দিরটি উত্তর ভারতীয় শহর অযোধ্যায় বিবাদপূর্ণ জমিতে তৈরি হচ্ছে। অনেক হিন্দু বিশ্বাস করে, এ জায়গাটি রামের জন্মস্থান ছিল। হিন্দু ধর্মমতে, রাম হলেন এমন দেবতা, যাকে সবচেয়ে বেশি উপাসনা করা হয়। তিনি মন্দকে পরাজিত করে ভালোর পক্ষে বিজয়ের প্রতীক। যদিও ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত বর্তমান রামমন্দিরের স্থানে তখন ছিল বাবরি মসজিদ। ১৫২৮ সালে নির্মিত ওই মসজিদটি মুঘল সম্রাট বাবরের নামে ছিল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উগ্রবাদী প্রচারণার পর ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের একটি দল ওই দিন মসজিদটি ভেঙে ফেলে।
অনেক বছর জায়গাটিতে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন– এ জায়গাটি একটি ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যারা সেখানে হিন্দু মন্দির নির্মাণকাজ তদারকি করবে। একই সঙ্গে অযোধ্যার উপকণ্ঠে ধন্নিপুরে একটি পৃথক জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়, যাতে বাবরি মসজিদের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সেখানে মুসলমানদের একটি মসজিদ নির্মাণ করা যায়। মসজিদটির নির্মাণ অবশ্য এখনও শুরু হয়নি। লেখক ও একাডেমিক ব্যক্তিত্ব অপূর্বানন্দ বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে এখন আমরা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে অলঙ্ঘনীয় বিভাজন তৈরির নীতি প্রতিষ্ঠা করেছি, যাতে তারা পাশাপাশি বাস করতে না পারে।’ অন্য স্থানে ৫ একর জায়গায় মসজিদ তৈরির নির্দেশনার কারণে একে তিনি ‘৫ একরের ন্যায্য’ রায় হিসেবে দেখেছেন। ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী এ রায়ে আনন্দিত হয়। অন্যরা এর সমালোচনা করে। তাদের যুক্তি, এ রায়ের কোনো আইনি ভিত্তি নেই এবং এর মাধ্যমে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক নীতিতে আপস করা হয়েছে।
স্থানীয়রা এও তুলে ধরেছে, ঐতিহাসিকভাবে অযোধ্যায় দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। এমনকি বাবরি মসজিদের ওই স্থানেও। কিন্তু ওই রায়ের ফলে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে যে, এটি সারাদেশে ডানপন্থি হিন্দুদের অন্য মসজিদ ধ্বংসের জন্য একই ধরনের চেষ্টাকে উৎসাহিত করছে। অপূর্বানন্দ যেমনটা বলেছেন, সোমবারের রামমন্দির উদ্বোধন কর্মসূচি বস্তুত ‘এটি হিন্দুদের তাদের ধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের ইচ্ছার হাতে তুলে দেওয়ার চূড়ান্ত ঘোষণা।’ আরএসএস হলো বিজেপি এবং তার অতি ডানপন্থি শরিক সংগঠনগুলোর মুরব্বি সংগঠন। মন্দিরের উদ্বোধন স্থানকে হিন্দু উপাসনার স্থান হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়। অথচ বছরের পর বছর এ স্থানটি নিয়ে আইনি লড়াই চলে এবং এমনকি এই জমি নিয়ে দাঙ্গাও সংঘটিত হয়।
রামমন্দির নিয়ে সংঘাতের ঘটনাপ্রবাহ
রামমন্দিরের জায়গা নিয়ে সংঘাতের প্রথম ঘটনা ঘটে ১৮৫৩ সালে। তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের এক দল দাবি করে, সম্রাট বাবরের আমলে এ বাবরি মসজিদ নির্মাণের জন্য মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এর পর ১৮৫৯ সালে উত্তেজনা বিশেষ গতি পায়, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা স্থানটিকে আলাদা অংশে বিভক্ত করে– মসজিদের ভেতরের অংশ মুসলমানদের জন্য এবং বাইরের অংশ হিন্দুদের জন্য। ১৯৪৯ সালে উপমহাদেশের স্বাধীনতার মাত্র দুই বছর পর মসজিদটি বিতর্কিত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। পুলিশি প্রতিবেদন বলছে, তখন মসজিদে হিন্দুদের মূর্তি আনা হয় এবং এর ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর পর মসজিদটিতে কোনো মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেনি। ১৯৫০ সালে উভয় সম্প্রদায় জায়গাটি তাদের দাবি করে বেশ কয়েকটি দেওয়ানি মামলা করে। যদিও শেষ পর্যন্ত আদালতের বাইরেই বাবরি মসজিদের ভাগ্য চূড়ান্ত হয়েছিল।
ভারতীয় রাজনীতিতে যে বিজেপি এখন আধিপত্য বিস্তার করে আছে, ১৯৮০-এর দশকে এটি অগুরুত্বপূর্ণ দল ছিল। তবে বিজেপি মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের জন্য দেশব্যাপী প্রচারণা চালিয়ে বিশেষ রাজনৈতিক চমক তৈরি করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন দলটির তৎকালীন প্রধান লালকৃষ্ণ আদভানি, যিনি পরে ভারতের উপপ্রধানমন্ত্রী (১৯৯৮-২০০৪) হিসেবে কাজ করেন। বিজেপি ও তার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মিত্রদের চাপে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ১৯৮৬ সালে বাবরি মসজিদের তালা খোলার জন্য আদালতের রায় মেনে নেন। এটি বিজেপি নেতৃত্বাধীন গ্রুপের উত্তেজনায় আরও ঘি ঢেলে দেয়।
১৯৯০ সালে আদভানি রামমন্দিরের দাবিতে ভারতের কেন্দ্রস্থলে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। নরেন্দ্র মোদি তখন ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের এক তরুণ ও উদীয়মান কর্মী। তিনি তখন বিজেপির সেই আন্দোলন সংগঠনে সহায়তা করেছিলেন। এর পর ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। এর পরবর্তী দাঙ্গায় সারা ভারতে প্রায় ২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আদালতে কয়েক বছর ঝুলে থাকার পর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে যুগান্তকারী রায় দেন। আদালত স্বীকার করেছেন– ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদে মূর্তি আনা এবং ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভেঙে ফেলা উভয়ই অপরাধ ছিল। তার পরও সেই অপরাধের ব্যাপারে কোনো শাস্তির কথা না বলে আদালত যে রায় দিয়েছিলেন, সেখানে ‘কোনো অনুশোচনা না দেখে হতাশ’ হয়েছে ভারতীয় মুসলমানরা। অপূর্বানন্দ বলেছেন, স্বাভাবিকভাবে তারা এটা অনুভব করেছে, তাদের যৌক্তিক উদ্বেগ আমলে নেওয়া হয়নি।
রামমন্দিরের অবস্থান ঠিক কোথায়?
অযোধ্যার পাশ দিয়ে বয়ে চলা সরযূ নদীর তীরে রামমন্দিরটি নির্মিত হচ্ছে। অযোধ্যার কথা প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে। অযোধ্যা ভারতের উত্তরে এবং সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত। দাপ্তরিকভাবে এটি শ্রীরাম জন্মভূমি মন্দির নামে পরিচিত, যা নাগারা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। উত্তর ভারতে এমনটি সাধারণ শৈলী। আর মন্দিরে যাওয়ার জন্য লম্বা খাড়া পাথরের সিঁড়ি আছে।
রামমন্দির কীভাবে মোদি ও ভারতের ২০২৪ সালের নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত?
বাবরি মসজিদ যেখানে ছিল, সেখানে রামমন্দির তৈরি করা বিজেপির তিনটি মূল প্রতিশ্রুতির অন্যতম ছিল। অন্য দুটি প্রতিশ্রুতি ছিল, জম্মু ও কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদার অবসান, যা ২০১৯ সালে বাতিল করা হয়েছে এবং আরেকটি ব্যক্তিগত আইনের জন্য অভিন্ন নাগরিক বিধি।
রামমন্দির উদ্বোধনের মাধ্যমে বিজেপির দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি পূরণ হলো। মন্দিরটি এমন সময়ে উদ্বোধন হলো, যখন কয়েক সপ্তাহ পরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারতের জাতীয় নির্বাচন। রামমন্দির আন্দোলন বিজেপিকে এরই মধ্যে রাজনৈতিকভাবে অনেক লাভবান করেছে। ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ তথা লোকসভায় ১৯৮৪ সালে বিজেপি ৫৪৩ আসনের মধ্যে মাত্র দুটিতে জিতেছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের এক দশকের মাত্র কিছু সময় পর ১৬১ আসন লাভের মাধ্যমে দলটি ভারতের এককভাবে বৃহত্তর দলে পরিণত হয়। যদিও প্রথম মেয়াদে বিজেপি মাত্র ১৩ দিন টিকে ছিল। কারণ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে দলটির সংশ্লিষ্টতা থাকায় তাদের সঙ্গে অন্য দলগুলো জোট করতে অস্বীকৃতি জানায়। সরকার গঠন করতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে বিজেপির তখন সংসদে ২৭২টি আসনের প্রয়োজন ছিল।
যদিও বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদ ‘ব্র্যান্ড’ ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা পায়। দলটি ১৯৯৮ সালে আবার ক্ষমতায় আসে এবং শরিকদের মিলে এটি ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভারতে ক্ষমতায় ছিল। এক দশক ক্ষমতার বাইরে থাকলেও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দলটি ফের ব্যাপক শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় আসে। মোদি হলেন বিজেপির সবচেয়ে বীরদর্পী নেতা। সোমবার রামমন্দির নির্মাণের মাধ্যমে মোদি আবারও তাঁর শাসনকাল দীর্ঘায়িত করার প্রত্যাশা করছেন।