বিশেষ প্রতিনিধি:
সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে ১২টিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে। এর মধ্যে ৯টিতে নৌকার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্ররা। জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া বিভাগের একমাত্র আসনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে লড়ছেন। বাকি দুটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলেও ভিন্নদলের বর্তমান দুই সংসদ-সদস্যের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সব মিলে সিলেট বিভাগে বিজয়ের ব্যাপারে ৪ মন্ত্রীসহ ৭ প্রার্থী নির্ভার থাকলেও শঙ্কায় আছেন একমাত্র প্রতিমন্ত্রী। বিভাগের সবকটি আসনের বিভিন্ন পর্যায়ের ভোটারদের সঙ্গে আলাপ করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সিলেট বিভাগের অধিকাংশ আসনেই নৌকার ভরাডুবি হবে।
জয়ের ব্যাপারে নির্ভার থাকা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা হলেন-সিলেট-১ (মহানগর-সদর) আসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি; সিলেট-৪ (কোম্পানীগঞ্জ-জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট) আসনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি; সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর-শান্তিগঞ্জ) আসনে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি; মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনে পরিবেশ, বন ও জলাবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এমপি; মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসনে জিল্লুর রহমান; মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনে সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ এমপি এবং হবিগঞ্জ-১ (সদর-লাখাই-শায়েস্তাগঞ্জ) আসনে অ্যাডভোকেট আবু জাহির এমপি। তবে হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনে ভরাডুবির শঙ্কায় আছেন বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। এই আসনে ৮ জন প্রার্থী থাকলেও প্রতিমন্ত্রীর জয়ের পথে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন (ঈগল)।
এছাড়া সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান। জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী মুহিব সংবাদ সম্মেলন করে তার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শরিকদের আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় শফিকুর রহমান চৌধুরী প্রার্থী হননি। দলের ছেড়ে দেওয়া আসনে এমপি হওয়া জাতীয় পার্টির ইয়াহইয়া চৌধুরী ও গণফোরামের মোকাব্বির খান এমপি এবার নৌকার বিজয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এছাড়া এ আসনে আরও ২ জন প্রার্থী রয়েছেন।
সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত হাবিবুর রহমান এমপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএমএ’র মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল (ট্রাক)। এই আসনের সাবেক দুই এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস ও শফি আহমদ চৌধুরীর কর্মী-সমর্থকরা নৌকার বিপক্ষে থাকায় জয়ের দৌড়ে ট্রাকের চেয়ে নৌকা পিছিয়ে পড়েছে। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর হাবিবুর রহমান সাবেক সংসদ-সদস্যের কর্মী-সমর্থকদের বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানি করার খেসারত দিচ্ছেন এ নির্বাচনে-এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলীয় কর্মীদের দাবি প্রতীক নয়, ব্যক্তির বিপক্ষে তাদের অবস্থান। এছাড়া এ আসনে জাতীয় পার্টির আতিকুর রহমানসহ (লাঙ্গল) ৪ জন প্রার্থী রয়েছেন।
সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে এগিয়ে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী (কেটলি)। কারণ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কেটলির বিজয় ত্বরান্বিত করতে কাজ করছেন। ফলে দলীয় প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ রয়েছেন নৌকা ডোবার শঙ্কায়। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টির শাব্বীর আহমদ (লাঙ্গল) নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ায় কেটলির প্রার্থী জয়ের সুভাস পাচ্ছেন। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আহমদ আল কবিরসহ (ট্রাক) আরও ৩ জন প্রার্থী রয়েছেন।
সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনে ৬ জন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী (সোনালী আঁশ) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা সরওয়ার হোসেন (ঈগল)। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি (নৌকা) অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন। এছাড়া এ আসনে জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিনসহ (লাঙ্গল) আরও ৩ প্রার্থী আছেন। দলীয় প্রার্থী রেখে শেষদিকে সোনালী আঁশের পক্ষে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা মাঠে নামায় নৌকা ঝুঁকিতে পড়েছে।
সুনামগঞ্জ-১ (জামালগঞ্জ-তাহিরপুর-ধর্মপাশা-মধ্যনগর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট রনজিত চন্দ্র সরকারের (নৌকা) বিপরীতে লড়ছেন দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী। তারা হলেন-টানা তিনবারের সংসদ-সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন (কেটলি) ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সেলিম আহমদ (ঈগল)। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টির আব্দুল মন্নান তালুকদার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এছাড়া রয়েছেন ৫ জন প্রার্থী।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে আওয়ামী লীগের চৌধুরী আব্দুল্লা আল মাহমুদের (নৌকা) জয়ের পথে প্রধান বাধা দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত ড. জয়া সেনগুপ্তা এমপি (কাঁচি)। এই আসনের ৭ বারের সংসদ-সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেন রয়েছেন শক্ত অবস্থানে। এছাড়া রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সচিব মিজানুর রহমান (ঈগল)।
সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ সাদিককে (নৌকা) কঠিন লড়াই করতে হচ্ছে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান এমপির (লাঙ্গল) সঙ্গে। টানা দুইবারের সংসদ-সদস্য ফজলুর রহমান রয়েছেন অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে। এছাড়া এই আসনে আরও ৩ জন প্রার্থী রয়েছেন।
সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারাবাজার) আসনে আওয়ামী লীগের মহিবুর রহমান মানিককে (নৌকা) চ্যালেঞ্জ করে প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক শামিম আহমদ চৌধুরী (ঈগল)। এ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার আভাস পাওয়া গেছে।
হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েলের (নৌকা) বিপরীতে রয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত টানা তিনবারের এমপি আব্দুল মজিদ খান (ঈগল)। রুয়েলের বাবা শরীফ উদ্দিনও এই আসনের এমপি ছিলেন। এছাড়া এ আসনে জাতীয় পার্টির শংকর পালসহ (লাঙ্গল) আরও ৭ জন প্রার্থী রয়েছেন।
মৌলভীবাজার-২ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল (নৌকা) রয়েছেন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। সাবেক দুই সংসদ-সদস্য তৃণমূল বিএনপির এমএম শাহীন (সোনালী আঁশ) ও দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত পদত্যাগী উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম সফি আহমদ সলমান (ট্রাক) তার সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন। এছাড়া সাবেক এমপি মো. আব্দুল মতিনসহ (কাঁচি) আরও ৫ জন প্রার্থী রয়েছেন।
সিলেট বিভাগে জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতাসীন দলের ছেড়ে দেওয়া একমাত্র আসন হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল)। এখানে নৌকার প্রার্থী না থাকলেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাবেক এমপি আব্দুল মুনিম চৌধুরী বাবুর (লাঙ্গল) বিপক্ষে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী (ঈগল)। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী মোহাম্মদ শাহেদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় কেয়ার জয় ত্বরান্বিত হয়েছে বলে মনে করছেন তার কর্মী-সমর্থকরা। এছাড়া এই আসনে আরও দুজন প্রার্থী রয়েছেন।