বিশেষ প্রতিবেদন:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়া কৌশলে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নির্বাচন ঠেকাতে বিরোধীদের আন্দোলনকে আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা। পুরোদমে নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত দলটি। নিজ নিজ আসনে ভোটারদের কাছে টানতে দিন-রাত কাজ করছেন নৌকার প্রার্থীরা। ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব তাদের। একই সঙ্গে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। অন্যদিকে ‘অসহযোগ’ আন্দোলন ঘোষণার পর তা বাস্তবায়নে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি। সারা দেশে গণসংযোগে ভোট বর্জনসহ পাঁচ দফা আহ্বান সংবলিত লিফলেট বিতরণ করছেন। পাশাপাশি হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচিও চলবে। নতুন বছরের শুরুতে আন্দোলন আরও তীব্র করবে।
আন্দোলনে পাত্তা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ
ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টি এখন শুধুই নির্বাচনে * অসহযোগে জনগণ সাড়া দেবে না
বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি পাত্তা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। এতদিন পালটা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে ছিল ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু এখন হরতাল-অবরোধ প্রতিহতেও ঢিলেঢালা ভাব আওয়ামী লীগে। এমনকি বিএনপি ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচিতেও গুরুত্ব দিচ্ছে না তারা। দলটির দৃষ্টি এখন শুধু নির্বাচনে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে শুরু থেকেই নানা কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনের এ ভোটে শেষ পর্যন্ত আমেজ ধরে রাখা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর এখন ক্ষমতাসীনদের মূল লক্ষ্য। দলটির নেতারা বলছেন-বিএনপির এসব কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। ফলে অতীতের অন্যান্য কর্মসূচির মতো এ কর্মসূচিও ব্যর্থ হবে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপি এখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু জনগণই তাদের বিরুদ্ধে অসহযোগ শুরু করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে অসহযোগ শুরু হয়েছে। তার প্রমাণ বাংলাদেশের হাট-বাজার, দোকানপাটে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক।
একই বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির এই অসহযোগ আন্দোলন দেশের ১৬ কোটি মানুষের বিপক্ষে। মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। বিএনপির অপরাজনীতি দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। এটা বারবার প্রমাণ হয়েছে। তাদের আন্দোলনে মানুষ সাড়া দেয়নি। হরতাল হয়নি। তাদের অবরোধ মানুষ প্রত্যাখ্যান করছে। এই কর্মসূচিতে দেশের মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ফলে তাদের (বিএনপি) এ কর্মসূচিও অতীতের অন্যান্য কর্মসূচির মতো ব্যর্থ হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, বিএনপি কখনই শান্তিপূর্ণ বা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেনি। তারা অতীতেও আন্দোলনের নামের মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এখনো আন্দোলনের নামে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। অতীতেও কখনো তাদের (বিএনপির) আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল না। ফলে তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এবারও তারা যে কর্মসূচি (অসহযোগ) ঘোষণা করেছে। এতেও জনগণের সমর্থন নেই। ফলে তাদের এ কর্মসূচিও ব্যর্থ হবে।
ক্ষমতাসীন দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, বিএনপি নিজেই অসহযোগিতার মধ্যে আছে। বিএনপি এই যে আন্দোলনের নামে যা কিছু করছে, এতে তো সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই। জনগণ কোনো ভাবেই তাদের এসব কার্যক্রম পছন্দ করছে না। ফলে তাদের কোনো কর্মসূচিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাদের সব কর্মসূচিই ব্যর্থ হবে। মানুষ এখন নির্বাচনমুখী। মানুষ তাদের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক যে অধিকার সেটা অক্ষুণ্ন রাখতে চায়।
গত ডিসেম্বরের পর থেকে বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচির দিনে পালটা কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ। এসব কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কঠোর অবস্থান দেখা গেছে। প্রায় প্রতিটি মিছিল-সমাবেশে বাঁশের লাঠি, স্টাম্প, হকিস্টিক নিয়ে শোডাউন দিতে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। প্রতিটি কর্মসূচিতে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হরতাল-অবরোধের প্রতিদিনই অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে ক্ষমতাসীনরাও। নানা কর্মসূচি নিয়ে সরব ছিল জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। কিন্তু এখন আর এসব কর্মসূচি পাত্তা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। বিএনপির হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে আগের মতো মাঠের কর্মসূচিতে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না দলটি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি-বিএনপি শুরু থেকে চেয়েছে নির্বাচন বন্ধ করতে। ২৮ অক্টোবরের পর তারা টানা হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের এসব কর্মসূচিতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। আন্দোলনে ‘ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন ভোটারদের নির্বাচনবিমুখ করে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। মাঠের কর্মসূচিতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না বলেই তারা এমনটি করছে। ফলে নিজেদের কর্মসূচিও সেভাবেই ঠিক করছে ক্ষমতাসীনরা। একই সঙ্গে কর্মসূচির আড়ালে বিএনপি ও তাদের দেশি-বিদেশী মিত্রদের নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাও রয়েছে আওয়ামী লীগের। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন, প্রার্থী যাচাই-বাছাই শেষে প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর আওয়ামী লীগের পুরো মনোযোগ নির্বাচনের দিকে। আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে। তারা মনে করছে এতে একদিকে যেমন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে অন্যদিকে দেশ-বিদেশে নির্বাচন নিয়ে কেউ প্রশ্নও তুলতে পারবে না। এরই অংশ হিসাবে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলেরই বিপুলসংখ্যক প্রার্থী স্বতন্ত্র নির্বাচনে নামলেও এখনই লাগাম টানেনি আওয়ামী লীগ। কোনো আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ বিজয়ী হতে না পারে, প্রতিটি আসনেই যেন উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারে, তেমনটিই চায় ক্ষমতাসীন দলটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোটের আমেজ ধরে রাখতে জোট শরিদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির নিয়েও কৌশলী ছিল আওয়ামী লীগ। দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটের মাঠে থাকতে দিলেও সবাইকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে, কেউ যেন নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশ নষ্ট না করে। অন্যদিকে ভোটের আমেজ ধরে রাখার পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতিও নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। জেলা, উপজেলা, থানা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের যত কমিটি আছে সেইসব নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ইতোমধ্যে দলের প্রার্থী বা উপজেলা পর্যায় থেকে ইউনিট বা কেন্দ্র ভিত্তিক তালিকাও করা হয়েছে। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে পরিবার, প্রতিবেশী ও স্বজনদের যতটা সম্ভব ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
সরকারকে ‘বড় ধাক্কা’ দিতে চায় বিএনপি
‘অসহযোগ’ আন্দোলন সফলে নানা তৎপরতা * ভোটের দিনসহ ৫ দিনব্যাপী ‘গণকারফিউ’ দেওয়ার চিন্তা
চলমান আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ পথে রেখেই সরকারকে ‘বড় ধাক্কা’ দিতে চায় বিএনপি। এজন্য কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক-এ তিন দিক থেকে নীরবে সরকারকে কাবু করার কৌশল নিয়েছে দলটি। এর অংশ হিসাবে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। যেখানে ভোট বর্জনসহ পাঁচটি দফা দিয়ে তা পালনের আহ্বান জানানো হয়। জনসমর্থন বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে দেশব্যাপী ব্যাপক গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করছে তারা। দেশের বাইরেও এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। থাকবে রাজপথে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিও। ভোটের দিনসহ পাঁচ দিন ‘গণকারফিউ’ দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে। এসব কর্মসূচিতে মিত্রদের সমর্থন পাওয়ায় আন্দোলন সফলে আশা দেখছে দলটি। একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
নেতারা আরও জানান, অনেক পর্যালোচনা করে নীতিনির্ধারকদের পরামর্শে ও আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। যে কারণে এই আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। পাঁচটি দফা পালনের যে আহ্বান জানানো হয়েছে তা বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। তবে তা বাস্তবায়নে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতটুকু বলা যায়, অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
তারা আরও জানান, ২৮ অক্টোবরের পর এই প্রথমবারের মতো গণসংযোগকে কেন্দ্র করে প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায় নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পেরেছেন। গত দুই দিনে ৬০ লাখের মতো লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। যুগপথে থাকা সমমনাদের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীরও তৎপরতা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সব সাংগঠনিক থানায় জামায়াত লিফলেট বিতরণ করেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও নিজ নিজ এলাকায় থেকে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। যে কারণে নেতাকর্মীদেরও আগের চেয়ে উজ্জীবিত দেখা গেছে। যা আগামী দিনের কর্মসূচিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সূত্রমতে, আগামীকাল রোববার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচি রয়েছে। একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল অথবা অবরোধ ও গণসংযোগের কর্মসূচি পালনের কথা রয়েছে। এরপর আন্দোলনের ধরন আবারও পরিবর্তনের কথা ভাবছে বিএনপি। যার মধ্যে ৩ জানুয়ারি থেকে ভোটের দিন ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘গণকারফিউ’ দেওয়ার কথা আলোচনায় রয়েছে। অসহযোগের মধ্যেই ‘গণকারফিউ’ দেওয়া হতে পারে। যেখানে জনগণকে বাসা থেকে বের না হওয়া, ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহণ বন্ধ এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধের আহ্বান জানানো হতে পারে। নতুন বছরের শুরুতে এই কর্মসূচির ডাক আসতে পারে। পাশাপাশি সে সময় সর্বশক্তি নিয়ে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জামায়াতে ইসলামী মাঠে থাকবে বলে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন বর্জন করা অন্যান্য রাজনৈতিক দলও পৃথকভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে অসহযোগের ঘোষণা নতুন করে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে, বিএনপি একটি উদারপন্থি রাজনৈতিক দল। যারা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এবং সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় আস্থাশীল হয়ে তাদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন পরিচালনা করে থাকে। লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশকে এই বাকশালী সরকার দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক গভীর অমানিশার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা। এবং সেই উদ্দেশ্যেই বিএনপি অসহযোগের মন্ত্রে সরকারকে দীক্ষিত করে দেশের আঠারো কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার প্রয়াস নিয়েছে। সরকারকে সংঘাতের পথ থেকে বেরিয়ে এসে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ উন্মুক্ত করতে দেশবাসীর প্রতি এই আবেদন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল এ দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসতে পারে। যা অর্জন করার উদ্দেশ্যে বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী আজ রাজপথে নেমেছে। বিএনপির জন্য নয়, কোনো ব্যক্তির জন্য নয়, বরং এ দেশের সব মানুষের মৌলিক ভোটের অধিকার তথা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রাম অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের রাজপথের আন্দোলন চলতেই থাকবে।’
বিএনপির বিরুদ্ধে ’৯৬ সালে অসহযোগের মধ্যেই হরতাল, ঘেরাও ও অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো ওই কর্মসূচি পালন করে। ২৭ বছর পর এবার বিএনপি ও জামায়াত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরই পুনর্বহালের দাবিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই কর্মসূচি দিয়েছে। সরকারকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করতে বিএনপি বুধবার এ আন্দোলনের ডাক দেয়। প্রশাসন, দেশবাসী ও দলীয় নেতাকর্মীদের ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা, সরকারকে কর, খাজনা, ইউটিলিটি বিল স্থগিত রাখা, ব্যাংকে টাকা জমা না রাখা, রাজনৈতিক মামলায় নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
বিএনপি মনে করে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চেয়েছে গণতান্ত্রিক বিশ্ব। বিএনপি, বাম ও ইসলামপন্থি অন্তত ৬৩ দল নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে এবারের নির্বাচনও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। এটি সরকারকে আরও বেশি কূটনৈতিক চাপে ফেলবে। পাশাপাশি দেশে অর্থনৈতিক সংকটও রয়েছে। এরপরও বিরোধী নেতাকর্মী ও সমর্থক যারা প্রবাসে থাকে তারা যদি অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখে, তাহলে চলমান ডলার সংকট আরও বাড়বে। দেশের অভ্যন্তরে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কিছু অংশও যদি ট্যাক্স এবং ইউটিলিটি বিল দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মামলায় প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসব নেতাকর্মীও যদি আদালতে হাজিরা দিতে না যান, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলন ও নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে, নাকি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করবে। দুই কাজ একসঙ্গে করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না। তদুপরি বর্তমানে বিএনপির ২৩ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী কারাগারে। সেখানে এখন বন্দিসংখ্যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ। এ অবস্থায় আরও নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে সরকার কোথায় রাখবে? সব মিলিয়ে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন সরকারকে নতুন করে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে ফেলবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম বলেন, ‘সরকারের প্রতিবন্ধকতা ও জুলুম নির্যাতন সত্ত্বেও জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে প্রহসনের নির্বাচনের যে আয়োজন করেছে, জনগণ তা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেবে না।’
যদিও বিএনপি ও সমমনাদের একটি অংশ এ-ও মনে করেন, বাস্তবতার আলোকে বর্তমান পরিস্থিতিতে কর, খাজনা, ইউটিলিটি বিল প্রদান বন্ধ, আদালতে মামলার হাজিরা না দেওয়া, ব্যাংকে টাকা না রাখার আহ্বান বাস্তবায়ন করা হয়তো কঠিন। প্রতীকী অর্থেই সরকারকে নানাভাবে ‘অসহযোগিতা’ করার পরিকল্পনা থেকেই এ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের ওপর যেমন চাপ তৈরি হবে, তেমনি জনগণও যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করবে। মানুষ সচেতন হলে অনেকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন তারা।