Sunday, November 24, 2024
Homeজাতীয়বিজয় দিবসের চেতনায় ভাস্বর বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী

বিজয় দিবসের চেতনায় ভাস্বর বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী

বিশেষ প্রতিবেদন:

আজ ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা। জন্ম নেয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, একটি স্বাধীন মানচিত্র এবং একটি স্বাধীন পতাকা। বিশ্ব ভূখণ্ডে জন্ম হয় বাংলাদেশের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিটি সদস্য তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা এবং নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল এবং সশস্ত্রবাহিনী হয়ে ওঠে জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব পালন ছাড়াও সশস্ত্রবাহিনী জাতির বিভিন্ন সংকট ও ক্রান্তিকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ও অবদান রাখার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা, লাখো শহিদের আত্মত্যাগ, নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম, সশস্ত্রবাহিনীর অকুতোভয় সদস্যদের সাহসিকতা এবং মহান বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সমুন্নত রাখার নিমিত্তে এ দিনে প্রতিটি মানুষ দেশের সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে।

 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদাররা নৃশংস গণহত্যা শুরু করে, যা অপারেশন সার্চলাইট হিসাবে পরিচিত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ইউনিট (১, ২, ৩, ৪ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল), ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ ও আনসারের বাঙালি সদস্যরা। পরবর্তীতে যুক্ত হন হাজার হাজার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও যুবক। মুক্তিসংগ্রাম পরিণত হয় সশস্ত্র সংগ্রামে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল তৎকালীন পকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রায় ২৬ হাজার বাঙালি অফিসার ও সৈনিক সরাসরি দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়। বাঙালি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনী বা মুক্তিবাহিনী। অপরদিকে সাধারণ ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, স্বেচ্ছাসেবী ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে গেরিলা পদ্ধতির আদলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় গণবাহিনী। প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ফোর্সেস গঠন করা হয়। এর অধীনে বিভিন্ন সেক্টর গঠিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের ওপর সেক্টরগুলোয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরের পাশাপাশি বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রতিটি সেক্টরে সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বল্পসময়ের মধ্যে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়।

 

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে আসা ২৭ জন বাঙালি অফিসার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশন সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় মিলিত হন। তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্রযুদ্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তেলিয়াপাড়ার এ বৈঠকে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তাব, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ, সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি, একক কমান্ড চ্যানেল প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধ মনিটরিং সেল গঠন, সামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কমান্ডার নিয়োগ ও দায়িত্ব বণ্টনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

 

১.

 

পরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আগের সিদ্ধান্তের আলোকে গোটা দেশকে চারটির স্থলে ছয়টি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়।

 

নতুন দুটি সামরিক অঞ্চলের মধ্যে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের ও মেজর নাজমুল হককে রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছয়টি অঞ্চলের কমান্ডারদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদের একই কমান্ড চ্যানেলে এনে সমন্বিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ একটি সুপরিকল্পিত রূপ লাভ করে। পরে ১০ থেকে ১৭ জুলাই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডারদের এক সম্মেলনে অপারেশন চালানোর সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর ও বিভিন্ন সাব সেক্টরে বিভক্ত করে পেশাদার দুরন্ত, দুর্ধর্ষ, অকুতোভয় বীর বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের এসব সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 

মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম পাঁচটি ও পরবর্তী সময়ে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত আরও তিনটি ব্যাটালিয়ন (৯, ১০ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল) মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেয়। সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মিত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘কে’ ফোর্স (৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল), ‘এস’ ফোর্স (২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল) এবং ‘জেড’ ফোর্স (১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল) নামে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রদত্ত একটি অটার, একটি ড্যাকোটা বিমান ও একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে ভারতের ডিমাপুরে গঠিত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত দুটি টাগ বোটকে ‘গার্ডেন রিচ ডক ইয়ার্ড’-এ যুদ্ধ জাহাজে রূপান্তরিত করে নামকরণ করা হয় ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর প্রথম নৌবহর ‘বঙ্গবন্ধু নৌবহর’ উদ্বোধন করা হয়।

 

বিচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘ আট মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিপাগল দেশপ্রেমিকদের সম্মিলিত আক্রমণে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ছিল, তখন জেনারেল ওসমানীসহ তৎকালীন উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করার জন্য ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক দূরদর্শী সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে চলমান যুদ্ধে নতুন গতিশীলতা আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরই অংশ হিসাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে অকুতোভয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে ২১ নভেম্বর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর বিভিন্ন স্থানে স্থল, নৌ ও আকাশপথে ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করে। এ ত্রিমুখী যৌথ অভিযান যুদ্ধের ফলাফলকে ত্বরান্বিত করে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন চলমান অন্যান্য যুদ্ধের জন্য নতুন মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নির্ভীক কমান্ডোরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৫টি সমুদ্র ও নদীবন্দরে বিধ্বংসী আক্রমণ পরিচালনা করেন, এতে হানাদার বাহিনীর ২৬টি জাহাজ ধ্বংস হয়। যা ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে সারা বিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম তৈল শোধনাগার বিমান হামলা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করে।

 

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে মিত্রবাহিনী যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করলে যৌথবাহিনীর আক্রমণের প্রচণ্ডতায় পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার টঙ্গীর কাছে পৌঁছে। ১৬ ডিসেম্বর সকালে তারা সাভারে অবস্থান নেয় এবং ১৬ ডিসেম্বর সকাল দশটায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। অবশেষে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটা এক মিনিটে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এ আত্মসমর্পণের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

 

বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর সশস্ত্রবাহিনীর চেয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম। যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর সংগঠিত হওয়া এবং বেড়ে ওঠা। যে যুদ্ধ ছিল সার্বজনীন জনসাধারণের যুদ্ধ। এ স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্রবাহিনীর অসংখ্য সদস্য শহিদ হয়েছেন, আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকে। সশস্ত্রবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে হয়ে থাকবে চিরস্মরণীয়। তাই তো সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের রয়েছে গভীর আস্থা, শ্রদ্ধা এবং একাত্মবোধ। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও চেয়েছিলেন একটি সুসজ্জিত শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তুলতে। তাই তো তিনি শত প্রতিকূলতা এবং অর্থনৈতিক সংকট থাকার পরও ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি এবং ১৯৮২ সালে যশোরে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী বঙ্গবন্ধুর সেই জনপ্রত্যাশার সমান্তরালে এসে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। আজ বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী পেশাগত উৎকর্ষে বিশ্বের যে কোনো বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়।

 

শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়, সশস্ত্রবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সশস্ত্রবাহিনী নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সশস্ত্রবাহিনী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। প্রতিকূল এবং বৈরী পরিবেশে নিজেদের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও আমাদের সশস্ত্রবাহিনী দেশের যে কোনো ধরনের সংকট এবং ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বদা নিয়োজিত। সাম্প্রতিকালে কোভিড ১৯ মোকাবিলায় সশস্ত্রবাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। শুধু দেশেই নয় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকাণ্ড সমাদৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, কঙ্গো, হাইতি, লেবানন, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মালি, সুদান, দক্ষিণ সুদান, কসভো, মোজাম্বিক, পশ্চিম সাহারা, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী শান্তিরক্ষার পাশাপাশি ওইসব দেশের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বর্তমানে প্রথম কাতারের দেশগুলোর মধ্যে একটি, যা আমাদের জাতির জন্য গর্বের বিষয়। ১৯৮৮ সাল থেকে অদ্যবধি শান্তিরক্ষা মিশনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সশস্ত্রবাহিনীর অনেক সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন এবং আহত হয়েছেন।

 

২০৩০ সালের জন্য নির্ধারিত ফোর্সেস গোলকে সামনে রেখে সশস্ত্রবাহিনী অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। সশস্ত্রবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিটি শাখাকে আধুনিক সমরাস্ত্র ও উপকরণ দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে লেবুখালীতে ৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন, সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য মাওয়া-জাজিরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি কম্পোজিট ব্রিগেড। এ ছাড়াও মিঠামইন ও ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। অত্যাধুনিক এমবিটি-২০০০ ট্যাংক, অ্যাম্ফিবিয়াস ট্যাংক ভিটি-৫, এমএলআরএস রেজিমেন্ট, মর্টার রেজিমেন্ট, সেল্ফ প্রোপেল্ড রেজিমেন্ট, কাসা সি-২৯৫ এর মতো অত্যাধুনিক পরিবহণ বিমান, অত্যাধুনিক ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র মেটিস-এম-১, বিমান বিধ্বংসী মিসাইল এফএম-৯০, অরলিকন গান সিস্টেমও বায়রাখতার টিবি-২ ড্রোন এর মতো অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে আজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুসজ্জিত। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে ২টি সাবমেরিন (বিএনএস নবযাত্রা এবং বিএনএস জয়যাত্রা) এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঁচটি গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট, দুটি পেট্রোল ফ্রিগেট, ছয়টি গাইডেড মিসাইল করভেট, অ্যাম্ফিবিয়াস ল্যান্ডিং ক্রাফ্ট ও মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট। একই সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ধারাবাহিকতায় আধুনিক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিমান, হেলিকপ্টার, রাডার, ড্রোন, আইএফএফ এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সংযোজন করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী মিগ-২৯, এফ-৭, ইয়াক ১৩০ এর মতো অত্যাধুনিক ফাইটার বিমান, বেল ইউ এইচ-১, এমআই-১৭, এমআই-১৭১ এর মতো আধুনিক হেলিকপ্টার এবং এএন-৩২, সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানগুলোকে ট্রান্সপোর্ট রোলে ব্যবহার করছে।

 

পরিশেষে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ গঠনে সশস্ত্রবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্রবাহিনী দেশের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালোবাসা-এ দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের আদর্শ ও দেশ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকারী সশস্ত্রবাহিনী তরুণ প্রজন্মের কাছে আজ আলোর দিশারীস্বরূপ। সশস্ত্রবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা- দেশপ্রেমিক গণমানুষের কাছে পাথেয় হয়ে আছে এবং থাকবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments