বিশেষ প্রতিনিধি:
১৪ দলীয় শরিকদের জন্য মাত্র সাতটি আসন ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মানতে পারছেন না জোট নেতারা। একই সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ তাদের দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরানোর নিশ্চয়তাও দেয়নি। ফলে নির্বাচনি মাঠে টিকে থাক কঠিন হবে শরিকদের।
আসনপ্রত্যাশী জোট নেতাদের অনেকেই মনে করছেন তাদের ‘সঠিক’ মূল্যায়ন করেনি। আবার কেউ কেউ প্রকাশ্যে আসন বণ্টন মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষমতাসীনদের কাছে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবিও জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জোট নেত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তারা। তাদের প্রত্যাশা-আজ-কালের মধ্যে তাদের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরেক দফা বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।
তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে শরিকদের নতুন কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়নি। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, যা হওয়ার হয়েছে। এর বাইরে তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া শরিকদের জন্য ছাড় দেওয়া আসনগুলোতে স্থানীয় নেতাকর্মীরাদের জোটের নেতাদের পক্ষে নির্বাচনি মাঠে নামানো কঠিন হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে দু-একটি আসনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নামার ঘোষণাও দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ফলে সাত আসনে ছাড় পেলেও নানা চ্যালেঞ্জে রয়েছে শরিক দলের নেতারা।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব মিলিয়ে শরিকদের ১৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এবার জোটের শরিকদের পক্ষ থেকে আসন বাড়ানোর দাবি ছিল। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বেশ কয়েকটি বৈঠক শেষে শেষ পর্যন্ত এবার শরিকদের জন্য সাতটি আসন ছাড়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি শরিক দলের নেতাদের অনেকেই। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বৃহস্পতিবার রাতেই জানিয়েছেন তারা এটা গ্রহণ করেননি।
শুক্রবারও নিজেদের একই অবস্থানের কথা জানান ইনু। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠান শেষে যদি সমঝোতা না হয় তাহলে কী করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুনর্বিবেচনায় কী ফলাফল হয় দেখা যাক। তারপর আমরা উত্তর দেব।
জানতে চাইলে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা যুগান্তরকে বলেন, আমাদের যে কয়টি আসন ছাড় দিয়েছে, তা আমরা মেনে নিয়েছি। হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ওনার বক্তব্য। তার বক্তব্য নিয়ে আমাদের দলের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি, তাই এই মুহূর্তে প্রতিক্রিয়াও জানাতে পারছি না।
জানতে চাইতে জাতীয় পার্টি-জেপি মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরাও মনে করি শরিকদের প্রতি বিশেষ করে আমাদের দলের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। আমরাও এটা পুনর্বিবেচনা করার জন্য আমাদের জোট নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছি। তিনি আরও বলেন, ১৭ তারিখের আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যেন এ বিষয়ে আলোচনার জন্য আরেকটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়, এটাও আমরা অনুরোধ করেছি।
এদিকে শুক্রবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আসন ছাড়ের দাবি জানিয়েছে তরিকত ফেডারেশন। দলটির চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, জোটের শরিকদের সাতটি আসনে নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এটাই চূড়ান্ত নয়। আমরা জানি, আমরা আছি। তিনি জোটের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের উদ্দেশেও বলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ওই দুটি আসনই দেন। জানতে চাইলে কিছুটা ক্ষোভের সুরে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, জোটের তো আমরা কোনো ফ্যাক্টরই না। ফ্যাক্টর তো ওয়ার্কার্স পার্টি আর জাসদ। এদের সঙ্গে আলোচনা হলেই সব হয়ে যায়। তারা তো আমাদের কথা চিন্তা করে না। এমন প্রেক্ষাপটে ১৪ দলের ছন্দ নষ্ট হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৪ দলের ছন্ন আর কতদিন থাকবে।
এদিকে শরিকদের প্রত্যাশা থাকলেও তাদের জন্য ছাড়া সাতটির বেশি আসন দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। এছাড়া শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনের অনেক স্থানেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। দলের প্রার্থী না থাকলে শেষ পর্যন্ত নেতাকর্মীদের বড় অংশই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নামবেন। ইতোমধ্যে স্থানীয় নেতাদের অনেকেই এ বিষয়ে ঘোষণাও দিয়েছেন।
হাসানুল হক ইনু গত তিনটি নির্বাচনে নৌকায় চড়ে সহজেই নির্বাচনে বৈতরণী পার হলেও এবার সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভা করে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিনের পক্ষ নিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিনও শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। মিরপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হালিম বলেন, জাসদ এ আসনে একসঙ্গে নির্বাচন করার মতো কোনো পরিবেশ রাখেনি। তাই এবার তৃণমূলের কর্মীরা ইনুর বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলাম ছানা বলেন, আমরা নৌকার বিরোধিতা করি না, তবে ইনুকে নিয়ে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের বিরোধিতা আছে।
পিরোজপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন কানাই লাল বিশ্বাস। আসন সমঝোতার অংশ হিসাবে ১৪ দলের শরিক দল জাতীয় পার্টি জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে আসন ছাড়া হয়েছে। ভাণ্ডারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র ফাইজুর রশিদ খসরু বলেন, তিনি ১৪ দলের প্রার্থী হলেও আওয়ামী লীগের লোক নয়। যেহেতু দলের সভাপতি বলেছেন স্বতন্ত প্রার্থী নির্বাচন করতে পারবেন, সেক্ষেত্রে দলীয় লোক স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করতে কোনো বাধা নেই। তাহলে কেন আমরা অন্য দলের প্রার্থীর সঙ্গে কাজ করব?
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে ফরিদুন্নাহার লাইলীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে জোটের প্রার্থী মোশারফ হোসেন নৌকা পেতে যাচ্ছেন। আসনটিতে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল্লাহ (আবদুল্লাহ আল মামুন) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মাঠে রয়েছেন। তার পক্ষে রামগতি ও কমলনগরের অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতারা সক্রিয়ভাবে ভোট চাচ্ছেন। রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ মুরাদ উন্মুক্তভাবেই আবদুল্লাহর পক্ষে কাজ করছেন। এতে জোটের প্রার্থী নৌকা নিয়ে এলেও ভোটে জেতা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।
সাতক্ষীরা-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন। এ আসনে দলীয় প্রার্থীর বদলে ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুৎফুল্লাহ নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবেন। তালা উপজেলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য প্রার্থী শেখ নূরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তৃণমূলে হতাশা বিরাজ করছে। সেজন্য তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাপে তিনি নির্বাচন করছেন। তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির এমপির বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অন্যদিকে ফেনী-১ আসনে এবার আর শরিকদের জন্য ছাড়া হয়নি। এতে উচ্ছ্বসিত এলাকার নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে মনোনয়ন দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আওয়ামী লীগ নেতা সফিকুল বাহার মজুমদার টিপু। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের পর এই আসন আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়। এবার এই আসন পুনরুদ্ধার করতে সবাই ঐক্যবদ্ধ।