লাইফস্টাইল প্রতিবেদক:
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার শীতের আগমন হয়েছে বিলম্বে। তবে বিলম্বিত এ শীত দেশের কিছু অঞ্চলে সত্যিই তা হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের পর গত ৪ দিন থেকে দেশে অনুভূত হচ্ছে শীতের প্রভাব। ক্রমেই তা তীব্র আকার ধারণ করছে। বুধবার থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলে মৃদু আকারে শৈত্যপ্রবাহ শুরুর আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বজায় থাকবে। ঢাকায়ও আরও কমবে তাপমাত্রা। এর ফলে ইতোমধ্যেই মানুষের জীবনযাত্রায় ছন্দপতন শুরু হয়েছে। গরম কাপড়ের ব্যবহার বেড়েছে। শীতবস্ত্রের বিক্রিও বেড়েছে। আর তাপমাত্রা কমার কারণে শীতকেন্দ্রিক রোগবালাই এবং ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বুধবার থেকে সারা দেশের তাপমাত্রা কমবে। বৃহস্পতিবার রাতে আরও ১ থেকে ৩ ডিগ্রি কমতে পারে। তাপমাত্রা কমার এই ধারাবাহিকতা ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা এবং যশোরসহ বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে যেতে পারে। ঢাকা বিভাগের মাদারীপুর, ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জ জেলায় তাপমাত্রা কমতে পারে। এসব এলাকায় মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশা থাকবে। মঙ্গলবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায় ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুসারে তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে সেটাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি হলে মাঝারি, ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি হলে তীব্র এবং তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রির নিচে নেমে এলে তাকে অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়ে থাকে। ছয় ঋতুর এই বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসকে শীতকাল বলা হয়। এই ২ মাসে বেশি শীত পড়ে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক বছরে তাতে ছন্দপতন হয়েছে। এ বছর ২৩ অগ্রহায়ণ থেকে ঢাকায় কিছুটা শীত অনুভূত হয়। তবে গত কয়েক দিনে তা ক্রমেই বেড়েছে। আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বুধবার থেকে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোনো কোনো এলাকার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসতে পারে। ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অবস্থা বজায় থাকতে পারে। এ সময়ে শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও ঢাকায় তীব্র শীত অনুভূত হবে।
শীতের সময়কাল সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাব করা হলেও এই সময়কালটা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের পর থেকে গত কয়েকদিনে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। এ সময়ে ঢাকায় রাতের তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি কমেছে। এছাড়াও শীত বেড়েছে অন্যান্য জেলায়। বিশেষ করে তীব্র শীতে দেশের উত্তরাঞ্চলে জনজীবন বিপর্যস্ত। আবহাওয়াবিদদের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় উষ্ণতা বাড়লে তাকে এল-নিনো পরিস্থিতি বলে। আর এই এল-নিনোর প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ে এবং শীতের প্রভাব কম থাকে। এ সময়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত বায়ুর গতিবেগ কম থাকে। সাগরপৃষ্ঠে বাষ্পায়নের হার কমে যায়, যে কারণে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে। জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে গেলে তা তাপমাত্রা কমাতে কম প্রভাব রাখে। এটা বৃষ্টিপাত কমানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। আর এই ‘এল নিনো’র প্রভাবে এবার শীতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি থাকতে পারে।
আবহাওয়া অফিসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাধারণত জুন থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সূর্য বাংলাদেশের অংশে খুব কাছে চলে আসে। আবার ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সূর্য দূরে যেতে থাকে। দূরত্ব বৃদ্ধির ফলে সৌরশক্তির পরিমাণ কমে আসে। দিনের ছোট হয়ে আসে রাত বড় হয়। এতে দিনে সূর্যকিরণ কম পায় রাতে বিকিরণের সময় বেশি থাকে। সে কারণে রাত ঠান্ডা থেকে ঠান্ডা হতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় এই শৈত্যপ্রবাহ। তবে জানুয়ারির আগে এবার জাঁকিয়ে শীত বা অতি শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা নেই।
গবেষণায় দেখা যায় এবার সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চলের দিকে সবচেয়ে বেশি শীত পড়বে। এতে বলা হয়েছে সিলেটের মানুষরা যেন আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকে এবং সবসময়ই সচেতন থাকে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণেই তাপমাত্রা পরিবর্তনের ধরন পালটে যাচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে সর্বোচ্চ স্বস্তিদায়ক তাপমাত্রা হিসাবে বিশ্বব্যাপী বিবেচনা করা হয়। এটা ধীরে ধীরে কমে ২০-১৮ ডিগ্রির নিচে নামতে থাকলে শীতের অনুভূতি হতে থাকে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন দেশের অন্যতম খাদ্যশস্য গম। আর গমের জন্য দিনে পর্যাপ্ত আলো এবং রাতে প্রচণ্ড শীত দরকার। অর্থাৎ গম উৎপাদনের জন্য ১৮-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযোগী। কিন্তু এবারের আবহাওয়ার যে চিত্র এবং শীত কম হওয়ার যে পূর্বাভাস করা হচ্ছে তাতে গমের ভালো ফলন পাওয়া যাবে না। এছাড়াও শীতে আমাদের আলু, নানা ধরনের সবজি, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসল হয়ে থাকে। এ ফসলগুলোর জন্য পর্যাপ্ত শীত দরকার। শীত বেশি হলে ফসলের উৎপাদন বাড়ে, কম হলে উৎপাদনে প্রভাব পড়ে। এ অবস্থার মোকাবিলায় জলবায়ু উপযোগী নতুন নতুন ফসল উৎপাদনে যেতে হবে। এজন্য গবেষণায় গুরুত্ব আরও বাড়াতে হবে।