লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ),
কয়েকদিন আগে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রভাবশালী আলেম ভারতের মাওলানা মাহমুদ মাদানির একটি ইন্টারভিউ শোনা হয়েছিল। যেটিতে উপস্থাপক তাকে বলেন-আপনি শুধু সংকট নিরসন না হলে কি ক্ষতি সেগুলোর কথা বলছেন কিন্তু সংকটের ধরন কী; সে বিষয়ে বলছেন না।
তখন মাহমুদ মাদানি বলেন-যে পরিস্থিতির কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে সেটি কি সবাই উপলব্ধি করছে না? যদি না করে তাহলে এটি আরও আশঙ্কার কথা। কারণ মূল সমস্যা কি সেটিই আমরা অনূভব করতে পারছি না।
বর্তমানে আমাদের ইমান-আমল সম্পর্কেও এমন আশঙ্কা তৈরি হওয়াটা অমূলক কিনা সেটি ভেবে দেখার সময় এসেছে। গত শনিবার (২ ডিসেম্বর) সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। আতঙ্কে অনেকেই ভবন ও ঘরবাড়ি ছেড়ে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসেন।
তবে আল্লাহর রহমতে এ ভূমিকম্পে বড় কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূ-কম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বলছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। এবার কেন সাড়ে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলো সে প্রশ্ন এখন সবার সামনে এসেছে।
মুসলমান হিসাবে আমাদের প্রথম কর্তব্য হলো-এ বিষয়ে মহান আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) কিছু বলেছেন কিনা এবং এর কী সমাধান দিয়েছেন তা মেনে চলা। হতাশার কথা হলো-আমাদের ইমান-আমলের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, এত বড় সতর্কবার্তাও আমাদের মধ্যে ন্যূনতম ভয় সৃষ্টি করে না। অথচ ইসলামি বিশ্বাস মতে ভূমিকম্প আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মানুষের জন্য সতর্কবার্তা এবং আজাবের অংশ।
হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সময় মদিনায় একবার ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পের পর খলিফা ওমর একটি ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি বলেন ‘হে লোকসকল! এই ভূমিকম্পের কারণ হলো তোমাদের পাপ। তোমরা এমন কিছু পাপ করছ, যার ফলে ভূমি কেঁপে উঠছে। আল্লাহর কসম করে বলছি, আবার যদি ভূমিকম্প হয়, তাহলে আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাব।’ (সূত্র : ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, আদ-দাওয়া ওয়াদা-দাওয়া, পৃষ্ঠা, ৫৩)।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন’ (সূরা শুরা : ৩০)। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৫৯)। রাসূল (সা.) বলেন, যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে। কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে, কিন্তু তা আত্মসাৎ করা হবে (অর্থাৎ যার সম্পদ সে আর ফেরত পাবে না)।
জাকাতকে ধরা হবে জরিমানা হিসাবে। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, একজন পুরুষ তার স্ত্রীর বাধ্যগত হয়ে মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে। বন্ধুকে কাছে টেনে নেবে আর পিতাকে দূরে সরিয়ে দেবে। মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল (কথাবার্ত) হবে। যখন সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসক রূপে আবির্ভূত হবে। সে সময় তোমরা অপেক্ষা কর রক্তিম বর্ণের ঝড়ের (অ্যাসিড বৃষ্টি), ভূকম্পনের, ভূমিধসের, রূপ বিকৃতির (লিঙ্গ পরিবর্তন), পাথর বৃষ্টির এবং সুতা ছেঁড়া (তাসবিহ) দানার মতো একটির পর একটি নিদর্শনগুলোর জন্য’ (তিরমিজি, হাদিস নং : ১৪৪৭)।
আল্লামা ইবনু কাইয়িম (র.) বলেন, মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুমতি দেন। ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তখন এ ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে। তারা মহান আল্লাহর কাছে তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মোনাজাত করে।
আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হতো, তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলত, ‘মহান আল্লাহ আমাদের সতর্ক করেছেন।’ কুরআন-হাদিসের এত স্পষ্ট বর্ণনা ও সতর্কবার্তার পরও আমাদের আচরণ এমন যে-এসব প্রাকৃতিক বিষয়। আমাদের কিছুই হবে না। অথচ আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলছেন-তোমরা কি তোমাদের নিরাপদ মনে করে নিয়েছ যে, যিনি আকাশে আছেন তিনি তোমাদের জমিনে বিধ্বস্ত করে দেবেন না যখন তা হঠাৎ থর থর করে কাঁপতে থাকবে? (সূরা মূলক-১৭)।
ভেবে দেখুন, ভূমিকম্প যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সতর্কবার্তা এ উপলব্ধি কি আমাদের হচ্ছে। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও ভূমিম্পের পর কিছু সময়ের জন্য হলেও আমাদের সমাজে একটি ভয়ের পরিবেশ কাজ করত। মসজিদে কয়েক ওয়াক্ত মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যেত। অথচ এখন ভূমিকম্প হলে আমরা অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে দেখছি। এর মূল কারণ হলো- আমরা ইমান-আমলের চর্চা ও দাওয়াত ছেড়ে দিয়েছি। ফলে এত বড় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটায় না।
মাওলানা মাহমুদ মাদানির ভাষায় যদি বলি, মূল সমস্যা কি সেটিই যদি আমরা অনুভব না করি তাহলে এটি তো আরও ভয়ের কথা। মূলত ধর্মীয় ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই পৃথিবী আজ হুমকির মুখে। ঝড়, ভারী বর্ষণ, সাইক্লোন, খরা, শীতকালেও গরম অনূভত হওয়া এরই পরিণাম। ভূমিকম্প হলে উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) তার গভর্নরদের দান-সদকা করার প্রতি জোর দিয়ে চিঠি লিখতেন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা মানুষকে বিপর্যয় (আজাব) থেকে নিরাপদ রাখে। আর তা হলো, যথাসাধ্য সমাজে প্রচলিত জিনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অবিচার রোধ করা। হাদিস শরিফে এসেছে, সমাজে ব্যভিচার বেড়ে গেলে ভূমিকম্প হয়।
এ সময় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে সবাই গুনাহ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহমুখী হওয়ার চেষ্টাই আমাদের প্রধান কর্তব্য। এ জন্য আলেমদেরও বিশেষভাবে উদ্যোগী হওয়া উচিত। প্রথাগত বয়ান আর গতানুগতিক কাজের বাইরে সাধারণ মুসলমানদের ইমান-আমলের উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ সময়ের দাবি। মূলত জনসাধারণের ধর্মীয় উপলব্ধি এভাবে কমতে থাকা আলেমদের কোনো গাফলতির ফল কিনা সেটিও ভেবে দেখতে হবে। প্রকৃতির এত পরিবর্তন আল্লাহর এত সতর্কবার্তা, এরপরও কি আমাদের ঘুম ভাঙবে না। তবুও কি আমরা জাগব না?