পিন্টু দেবনাথ, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি::
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে সনাতন ধর্মের অবতার পুরুষ ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণের রাসপূর্ণিমা তিথিতে মহারাসলীলা মঙ্গলবার ঊষালগ্নে সাঙ্গ হলো।
বর্ণিল আয়োজনে তুমুল হৈ চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ও উল্লুল ধ্বনির মধ্য দিয়ে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা ৮নং মাধবপুর ইউনিয়নের শিববাজারস্থ জোড়ামন্ডপে এ মহারাসলীলার আয়োজন করেন মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘ। ১৮১ তম এই মহারাসলীলায় মিলনমেলায় পরিণত হয়। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ঢল নামে।
সোমবার দুপুর ১২টা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা রাখালনৃত্য পরিবেশন করা হয়। সন্ধ্যার পর মাধবপুর (শিববাজার) জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরা ১৮১ তম বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি যোগেশ্বর সিংহের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ ও নির্মল সিংহ পলাশের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবজিৎ সিংহ। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি (অ্যাডমিন এন্ড ফিন্যান্স) সৈয়দ হারুন অর রশীদ, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম, পুলিশ সুপার মো: মনজুর রহমান, পিপিএম (বার), কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়নাল আবেদীন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মাধবপুর ইউপি চেয়ারম্যান আসিদ আলী, মণিপুরি সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিনহা প্রমুখ।
অন্যদিকে উপজেলার আদমপুরে মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে মৈতৈ মণিপুরি সম্প্রদায়ের রাস উৎসব উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আদমপুর মণিপুরি মহারাস উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে কমিটির আহবায়ক থৌনাওজম নিরঞ্জন সিংহের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব কবি সনাতন হামোম এর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মণিপুরি রাসোৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: মোকাম্মেল হোসেন। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব সত্যজিত কর্মকার। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়নাল আবেদীন, ভারতের মণিপুর রাজ্যের রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র কালচারাল ফাউন্ডেশনের ট্রেজারার তখেলম্বম ইরাবত, মুতুয়া মিউজিয়াম এর পরিচালকমুতুয়া বাহাদুর।
মণিপুরি অধ্যূষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে আশ্বিন মাসের শেষ ভাগেই উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। উপজেলার মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে ওঠে একদিনের এ আনন্দ উৎসবে।
উল্লেখ্য, মণিপুরিদের প্রধান উৎসব রাসপূর্ণিমা বা রাস উৎসব শরতের পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয়। তার আবেদন ধর্মের সীমানা ভেঙে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছে।
দিনের বেলায় রাখালরাস আর রাতে মহারাস অনুষ্ঠিত হয়। রাখালরাসের মঞ্চ মাঠের মাঝখানে ভূমিসমতলে হয়ে থাকে, যাকে ঘিরে বৃত্তাকারে কলাগাছের বেষ্টনী। চারদিকে বসে মেলা। দেশের নানা জায়গা থেকে সওদাগরের দল এই এক দিনের জন্য আগের দিন থেকে এসে পসরা সাজায়। সঙ্গে থাকে মণিপুরিদের পোশাক, হস্তশিল্প, বইপুস্তক। রাখালরাস শেষ হয় গোধূলিবেলায়। কৃষ্ণ তাঁর গোপসখাদের নিয়ে গরুর পায়ের খুরে রাঙা আলোয় ধূলি ওড়াতে ওড়াতে ঘরে ফিরে আসেন। রাখালরাস শেষেই কিন্তু দিনের মেলা সাঙ্গ হয় না। লোকজনের কেনাকাটা, গল্পগুজব, খাওয়াদাওয়া চলতে থাকে।
পরম আরাধ্য এক সত্তার সঙ্গে মানুষে প্রেমাকুল আত্মার মিলনকে গীত-নৃত্য-বাদ্য-যন্ত্রসহযোগে প্রকাশ করার এক পরিবেশনা শিল্প রাস। শ্রীমদ্ভাগবত, চৈতন্যদর্শন কিংবা বৈষ্ণবীয় সহজিয়া ধারার দর্শনের সীমা ছাড়িয়ে যা মণিপুরি জনপদের নিজস্ব শিল্প প্রকাশরীতির সঙ্গে মিলেমিশে নতুন এক অবয়ব নিয়েছে। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যাপিত জীবনের বেদনা ও অনুভূতি যেখানে স্পন্দিত হয়ে ওঠে।
মণিপুরে রাসলীলা প্রবর্তনের একটি গল্প প্রচলিত আছে। মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র যখন কাঞ্চিপুর নামের এক অঞ্চলে বাস করতেন, তখন এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, শ্রীকৃষ্ণ নিকটবর্তী ভানুমুখ পাহাড়ে কাঁঠালগাছ হয়ে রাজার জন্য অপেক্ষা করছেন। পরদিনই রাজা সেই পাহাড়ে গিয়ে কাঁঠালগাছ খুঁজে পেলেন। গাছটি কেটে রাজধানীতে আনা হলো। রাজধানীর খ্যাতনামা শিল্পীকে রাজা তার স্বপ্নে দেখা কৃষ্ণমূর্তির অনুকরণে কাঠের মূর্তি গড়তে আদেশ দিলেন। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষেই তিনি ওই বছর অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা পূর্ণিমাতে মহারাসলীলা উৎসব প্রবর্তন করেন। মেয়ে বিম্বাবতীও সেই রাসে অংশ নেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭৭৯ সালে। রাসলীলার গানগুলো বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা জয়দেব, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের পদাবলি থেকে সংগৃহীত। বাংলা, ব্রজবুলি, মৈথিলি ও সংস্কৃত ভাষার পদ সংকলিত হলেও সাম্প্রতিক কালে মণিপুরি ভাষাতেও (বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ) রাসলীলার পদ বা গান রচিত হচ্ছে।
সবশেষে রাধা-কৃষ্ণের যুগলরূপের আরতি করা হয়। কিন্তু পরমাত্মা কৃষ্ণ তো জীবাত্মা রাধার সঙ্গে চির-একাত্ম হতে পারেন না। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’র মতো তার আসা-যাওয়ার লীলা।
তাই নিশান্তে কৃষ্ণের বচনানুসারে রাধা ও গোপিণীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যায়। এই প্রত্যাবর্তন গভীর বেদনাবহ, পরমপুরুষের বিচ্ছেদের সুরে ঘেরা। রাধার চোখের জলে ফেরার সে পথ ধোয়া। রাসলীলায় কৃষ্ণসঙ্গ লাভের এই একটি রাত রাধার জীবনে একটি কালেরই প্রতীক, যার আঁধারে প্রতিটি বৈষ্ণব খুঁজে চলে পরমসত্তাকে অনুভবের স্পন্দন।
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গণে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, আদমপুরের মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্সসহ আরো দুটি মন্ডপ প্রাঙ্গণে মণিপুরি মী-তৈ সম্প্রদায়ের আয়োজনে হয়েছে মহারাসোৎসব।
রাস উৎসব ঘিরে প্রতিবারের মতো এবারও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়।
এ বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষে মণিপুরি ললিতকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মণিপুরি তাতঁবস্ত্র প্রদর্শনী ও শিববাজার এলাকায় বিশাল মেলা বসে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মহারাসলীলা অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে।