ইসলাম প্রতিদিন:
পৃথিবীর সব নবী-রাসুলের কথাবার্তা ও ভাষণ ছিল সত্য, সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী। মহান আল্লাহ তাঁদের সুবক্তা হওয়ার গুণাবলি ও যোগ্যতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। সেগুলো কাজে লাগিয়ে তাঁরা মানুষের হৃদয়রাজ্য জয় করেছেন । পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন দ্বিনের দাওয়াত।
অনেক নবী-রাসুলের ভাষণের চুম্বকাংশ কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। আখেরি নবী মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রদত্ত ভাষণ, ভাষণের নীতি সব কিছু হাদিস ও সিরাতের কিতাবে সংরক্ষিত আছে। এগুলোর ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার করা বড় প্রয়োজন। এখানে মুহাম্মদ (সা.)-এর ভাষণের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হলো :
ভাষণের বিভিন্ন মঞ্চ
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্থান-কাল-পাত্রভেদে কখনো দাঁড়িয়ে কিংবা বসে ভাষণ দিয়েছেন।
নবুয়তপ্রাপ্তির পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সাফা পাহাড়ে উঠে স্বীয় কুরাইশ গোত্রের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিত করে প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস : ৪৬১১)
মসজিদ-ই-নববীতে মিম্বার তৈরির আগে খেজুরগাছের গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৭২, জামে তিরমিজি, হাদিস : ৫০৫)
এক নারী সাহাবির সহায়তায় মিম্বার তৈরি হলে সেখানে দাঁড়িয়ে মুহাম্মদ (সা.) ভাষণ দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯১৭)
এ ছাড়া তিনি যুদ্ধের ময়দানে ও সমতল ভূমিতে ভাষণ দিয়েছেন।
তবে সবাই যেন তাঁর ভাষণ শুনতে পায় এবং তাঁকে দেখতে পায় সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতেন। শ্রোতাদের প্রতি দৃষ্টি বিনিময় করতেন।
গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ধরন
নবী করিম (সা.) ভাষণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহজ-সরল বাক্য ব্যবহার করতেন। অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য ভাষা পরিহার করতেন। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কথা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব দু-তিনবারে শেষ করতেন।
আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) যখন কোনো কথা বলতেন তখন তা বুঝে নেওয়ার জন্য তিনবার বলতেন। আর যখন কোনো গোত্রের কাছে এসে সালাম দিতেন, তাদের প্রতি তিনবার সালাম দিতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৪)
ভাষণের দারুণ কৌশল
রাসুল (সা.)-এর ভাষণের শব্দগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও ব্যাপক অর্থবহ, মর্মস্পর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। যা শুনে বিবেকের দুয়ার খুলে যেত। হিদায়াতের নুরে হৃদয় আলোকিত হতো। তিনি ভাষণের মধ্য প্রায় সময় প্রশ্ন করতেন। শ্রোতারা সচেতন ও সক্রিয় হয়ে উঠত। সাহাবায়ে কেরাম বেশির ভাগ সময় জবাব না দিয়ে আদবের সঙ্গে বলতেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন। তাঁর কণ্ঠে বলিষ্ঠ কথা ছোট-বড় সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। সাধারণত মসজিদের ভাষণ প্রদানের সময় তিনি হাতে লাঠি রাখতেন। কখনো তার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। আরো প্রয়োজনমতো বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করার কথাও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত ভাষণের রহস্য
রাসুলুল্লাহ (সা.) সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিতে পছন্দ করতেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছেন। ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ ছিল কিছুটা দীর্ঘ। এমন আরো কয়েকটি দীর্ঘ ভাষণ আছে। তবে সেগুলো বেশি দীর্ঘ নয়। আবু ওয়াইল (রহ.) বলেন, আম্মার (রা.) আমাদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ খুতবা প্রদান করলেন। তিনি যখন মিম্বার থেকে নেমে এলেন, তখন আমরা বললাম, হে আবুল ইয়াকজান! আপনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ খুতবা দিয়েছেন। যদি কিছুটা দীর্ঘ করতেন আরো ভালো হতো। তখন তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে নামাজকে দীর্ঘ ও খুতবাকে সংক্ষিপ্ত করা মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির পরিচায়ক। সুতরাং নামাজকে দীর্ঘ ও খুতবাকে সংক্ষিপ্ত করো। কোনো কোনো বয়ান অনেক সময় জাদুর মতো হয়ে থাকে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৮৮২ )
জুমার খুতবার পদ্ধতি
আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন জুমার খুতবা দিতেন প্রথমে হামদ ও সানা পেশ করতেন। তারপর বক্তব্য দিতেন। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন খুতবা দিতেন তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় রক্তিমবর্ণ হতো। স্বর উঁচু হতো এবং কঠোর রাগ প্রকাশ পেত। মনে হতো, তিনি যেন আক্রমণকারী বাহিনী সম্পর্কে সতর্ক করছেন। বলছেন, তারা তোমাদের সকালে আক্রমণ করবে এবং বিকেলে আক্রমণ করবে। তিনি বলতেন, আমি এমন অবস্থায় প্রেরিত হয়েছি যে আমি ও কিয়ামত এ দুটির মতো এবং মধ্যমা ও শাহাদাত অঙ্গুলি মিলিয়ে দেখাতেন। তিনি বলতেন, উত্তম বাণী হলো আল্লাহ তাআলার কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ হলো মুহাম্মদের আদর্শ। নিকৃষ্ট বিষয় হলো বিদআত। সব বিদআত হলো পথভ্রষ্টতা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৮৭৮)
হৃদয়ছোঁয়া ভাষণ
রাসুলুল্লাহ (সা.) মাঝেমধ্যে এমন জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন, যা শুনে মানুষের অন্তর মোমের মতো গলে যেত। চোখ দিয়ে প্রবাহিত হতো অশ্রুর ফোয়ারা। ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, একবার ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রা.) আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের সঙ্গে নামাজ আদায়ের পর আমাদের দিকে ফিরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যাতে আমাদের চোখ অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়। অন্তর ভীতসন্ত্রস্ত হয়। আমাদের মধ্যে একজন বলল, হে আল্লাহর রাসুল! মনে হচ্ছে, এ আপনার বিদায়ি ভাষণ। কাজেই আপনি আমাদের আরো কিছু অসিয়ত পেশ করুন। তখন তিনি বলেন, আমি তোমাদের তাকওয়া অবলম্বনের জন্য বলছি এবং শোনা ও মানার জন্যও। যদিও তোমাদের আমির হাবশি গোলাম হয়। কেননা তোমাদের মাঝে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে, তারা বহু মতভেদ দেখতে পাবে। এমতাবস্থায় তোমাদের উচিত হবে আমার ও আমার খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নতের অনুসরণ করা; যাঁরা সত্য ও ন্যায়ের অনুসারী। তোমরা তাঁদের দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করবে। তোমরা বিদআতের অনুসরণ ও অনুকরণ করা থেকে দূরে থাকবে। কেননা প্রতিটি নতুন কথাই বিদআত এবং প্রতিটি বিদআত গুমরাহি। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৫৫২)
ভাষণ থেকে শিক্ষা
আল্লাহর রাসুল (সা.) সর্বদা উম্মত নিয়ে ফিকির করতেন। তাদের মঙ্গল, কল্যাণ ও দুনিয়া-আখিরাতের মুক্তির সামগ্রিক বিষয় নিয়ে পেরেশান ছিলেন। মুক্তার চেয়ে দামি তাঁর প্রতিটি কথায় তা স্পষ্ট। তিনি কখনো ভাষণের মধ্যে কাউকে নিয়ে উপহাস করতেন না। কারো গিবত চর্চা করতেন না। মুগ্ধকর সুভাষণ ছিল তাঁর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। মহানবী (সা.)-এর ভাষণ থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।