অনলাইন ডেস্কঃ
আজ থেকে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে শুরু হতে যাওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপের আঁচ পাওয়া মুশকিলই ছিল। অথচ ছোট পাহাড়ি শহর ধর্মশালা প্রায় পুরোটাই বাহারি সাজ নিয়ে বসে আছে, ঢোল বাজিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর অপেক্ষায়ও।
ব্র্যাড পিটের ‘সেভেন ইয়ারস ইন তিব্বত’ মুভিটা দেখে থাকলে লাসার ছবিগুলো পর পর চোখের সামনে ভেসে ওঠার কথা। তবে পৃথিবীর ছাদ বলে খ্যাত এই শহরটিতে যাওয়ার ছাড়পত্র খুব সহজে মেলে না। স্বায়ত্তশাসনের আড়ালে মূলত চীনের শাসনাধীন তিব্বতের রাজধানীতে চাইলেই ছুটে যেতে না পারা পর্যটকদের জন্য বিকল্প এক ‘লিটল লাসা’ হচ্ছে হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালা। প্রদেশটির শীতকালীন রাজধানী শহরে বহুদিন ধরেই আবাস নিজের জন্মস্থান তিব্বত থেকে পালিয়ে আসা তেনজিং গিয়াতসোর।
যিনি চতুর্দশ দালাই লামা হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাঁর পিছু নিয়ে আসা হাজারো তিব্বতি উদ্বাস্তু এত দিনে ধর্মশালাকে করে নিয়েছেন একান্তই আপন। এখানকার স্থাপত্য রীতিতেও লাসায় দালাই লামাদের শীতকালীন প্রাসাদ পোটালা প্যালেসের প্রভাব। ধলাধর মাউন্টেন রেঞ্জ ঘেরা অনিন্দ্যসুন্দর যে হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (এইচপিসিএ) স্টেডিয়াম, এর প্যাভিলিয়ন আর উল্টো দিকের মিডিয়া সেন্টার ভবনের নকশায়ও যেন এক টুকরা লাসা এসে বসে আছে!
আগের রাতের দিল্লি আর গতকাল সকালের ধর্মশালার তুলনায় মনে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক ছিল যে এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপের দামামা ছোট্ট লাসাতেই সবচেয়ে বেশি বাজছে না তো? দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের বিশাল ডিজিটাল স্ক্রিন ছাড়া আর কোথাও আজ থেকে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে শুরু হতে যাওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপের আঁচ পাওয়া মুশকিলই ছিল।
অথচ ছোট পাহাড়ি শহর ধর্মশালা প্রায় পুরোটাই বাহারি সাজ নিয়ে বসে আছে, ঢোল বাজিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর অপেক্ষায়ও।
শুরুটা এখানকার গ্যাগাল এয়ারপোর্ট থেকে। সেখান থেকে বের হওয়ার পর কখনো উঁচু আবার কখনো নিচু রাস্তার দুই ধারে শুধুই বিশ্বকাপের চিহ্ন। শহরের প্রতিটা যাত্রীছাউনিতে ওয়ানডের বিশ্ব আসরের ব্র্যান্ডিং।
একটু পরপরই বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড আর ব্যানারে ছবি হয়ে ঝুলতে থাকা অনুরাগ ঠাকুরের বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্বাগত বার্তা। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) সাবেক এই সচিব এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য, সম্প্রচার, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী। ক্রিকেট প্রশাসক থাকার সময় ধর্মশালায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ে আসার প্রাণপুরুষ তিনি। অনুরাগ ঠাকুরের উদ্যোগে ছোট ধর্মশালাও বিশ্বকাপ উন্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বড় শহরের সঙ্গে দিব্যি পাল্লা দিচ্ছে।
অবশ্য সাজসজ্জায় কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না আজ উদ্বোধনী ম্যাচের শহর আহমেদাবাদও।
গত বিশ্বকাপটি যেখানে শেষ হয়েছিল, আজ ঠিক সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে আরেকটি আসর। প্রথম ম্যাচেই যে মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ফাইনালের জন্ম দেওয়া ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড। ‘টাই’ হওয়ার পর সুপার ওভারেও দুই দলের রান সমান হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেশি বাউন্ডারি মারার হিসাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইংলিশদের হারিয়ে আগেরবারের জ্বালা জুড়িয়ে নিতে চাইবে অন্যতম ফেভারিট কিইউরা। পর পর দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা নিউজিল্যান্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ফেভারিটের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।
তবে এক যুগ পর যখন বিশ্বকাপ ফিরছে ভারতীয় উপমহাদেশে, তখন এই অঞ্চলের একাধিক দেশও শিরোপার দাবিদার নিশ্চিতভাবেই। অনিশ্চিত চরিত্রের পাকিস্তান যেমন আছে, তেমনি যেকোনো ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের বিবেচনা আগাম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ভারতের নামটিই উচ্চারণ করাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। শেষবার এই অঞ্চলের বিশ্বকাপ তারাই জিতেছিল। নিজেদের মাঠে আরেকটি বিশ্বকাপ আসতে আসতে অবশ্য উইকেটের চরিত্র বদলে, সুচিন্তিত ভাবনার সঙ্গে প্রযুক্তির যোগ ঘটিয়ে এবারের ভারত আরো বেশি দানবীয়। আর ক্রিকেট বাণিজ্যের ‘দানব’ তো তারা বহুকাল আগে থেকেই। লর্ডস আর মেলবোর্ন ক্রিকেট তীর্থের মর্যাদা নিয়ে থাকলেও এই ভারত আরেকটি ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে। সেটি ক্রিকেট বাণিজ্যে। আজ থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপ যে ক্রিকেটের আয়-রোজগারের প্রাণকেন্দ্রেই ফিরছে, তা কেউ অস্বীকারও করছে না।
এমন সময়ে ফিরছে, যখন ওয়ানডে ক্রিকেটের সামনেও এক গভীর সংকট। টি-টোয়েন্টির ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট এমন জাঁকিয়ে বসেছে যে ক্রিকেটের আইন প্রণেতা এমসিসির সভাপতিও মনে করছেন ওয়ানডেটা শুধু বিশ্বকাপেই হওয়া উচিত। অথচ ক্রিকেটের বৈশ্বিক জনপ্রিয়তার শুরু রঙিন পোশাক আর সাদা বলের ওয়ানডে দিয়েই। বাড়ন্ত কুড়ি-বিশের ক্রিকেট যখন এটিকে গিলে ফেলার আলোচনা তুলে দিয়েছে, তখন একের পর এক দ্বিপক্ষীয় সিরিজের সাফল্যে তিন নম্বরে থেকে এই বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব শেষ করা বাংলাদেশও আরেকবার নিজেদের সক্ষমতা দেখানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে।
নানা অব্যবস্থাপনা পেছনে ফেলে বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর অপেক্ষা আর বেশিক্ষণের নয়। শুরু ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড মহা লড়াই দিয়ে, মাঠের লড়াই জমিয়ে তুলে অন্য দলগুলোও চাইবে সংকটকাল থেকে ওয়ানডে ক্রিকেটকে পার করে নিতে। গত বিশ্বকাপের ফাইনালই যেমন এই সংস্করণের যথার্থতা প্রমাণ করতে যথেষ্ট ছিল। সে জন্যই বোধ হয় আইসিসিও এবারের বিশ্বকাপের স্লোগান হিসেবে বেছে নিয়েছে এটিকে, ‘ইট টেকস ওয়ান ডে’! জমজমাট একদিন বারবার এলে এবারের বিশ্বকাপের ঢোলের বাদ্যিটাও আরো উচ্চকিত হতে থাকবে।