Tuesday, October 21, 2025
Homeসিলেট বিভাগমৌলভীবাজারচা-বাগানে মদের সঙ্গে ‘সোহাগা’ পান 

চা-বাগানে মদের সঙ্গে ‘সোহাগা’ পান 

 

স্টাফ রিপোর্টারঃ

মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন চা বাগানে দেশীয় সস্তা নেশা জাতীয় দ্রব্য চা শ্রমিকরা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। শ্রমিকরা ‘মদের সঙ্গে সোহাগা’ নামের এক ভয়ংকর দ্রব্য মিশ্রিত পানীয় পান করে প্রতিনিয়ত অসুস্থ হচ্ছে, কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। সমাজের অজ্ঞতা, দারিদ্রতা ও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে এই ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছে চা বাগান শ্রমিকরা।

 

মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়া চা বাগানের শ্রমিক অরুন সাঁওতাল বলেন, আগে মাঝে মাঝে দেশি মদ পান করত। এখন কিছু দোকান থেকে ৩০-৪০ টাকায় ‘সোহাগা মদ’ পাওয়া যায়। এটা খেলে দ্রুত নেশা হয়। কিন্তু পরে শরীর ভীষণ খারাপ লাগে। অনেকে এগুলো পান করে আর কাজে যেতে পারে না।

 

একই বাগানের নাম প্রকাশে একজন বৃদ্ধা নারী শ্রমিক বলেন, চা বাগানে অধিকাংশ পুরুষ লোক ৬০ বছরের বেশি আয়ু পায়না। বিষাক্ত মদ পানের কারনে শীররের অঙ্গ অসুস্থ হয়ে শরীরে পানি লেগে মারা যায়। চা বাগানে খেয়াল করলে দেখা যাবে স্বামী হারা বিধবার সংখ্যা বেশি। ওই বৃদ্ধা নারী আরো জানান, আগে চা বাগান গাছের শেখড়, গুড়, চাল দিয়ে দেশি মদ তৈরি হতো। কিছু বাগানের লোক এগুলো সেবন করতো। কিন্তু এখন মদ তৈরিতে কিছু লোক সোহাগা ব্যবহার করে। এই মদে সোহাগা মেশায় বলে দাম কম পড়ে। কিন্তু এতে শরীর নষ্ট হয়। এই সোহাগা মিশ্রিত মদ খেয়ে অনেক লোক অকালে মারা যান।

 

চিকিৎসকরা বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন। মাধবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. ইমরুল হাসান জাহাঙ্গীর বলেন, সোহাগা বা বোরাক্স কোনোভাবেই খাওয়ার উপযোগী পদার্থ নয়। এটি শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক। মদের সঙ্গে মেশালে শরীরে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া হয়ে লিভার, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্র দ্রুত বিকল হয়ে যায়। অনেক সময় অল্প পরিমাণেই মৃত্যু ঘটতে পারে।

বাগানের শ্রমিক নেতারা জানান, শ্রমিকদের মধ্যে সস্তা নেশার প্রতি আসক্তি বেড়ে গেছে। আমরা শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে এসব মদ খাওয়া বিপজ্জনক। কিন্তু তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব। প্রশাসনও মাঝে মাঝে অভিযান চালায়। এরপর আবার আগের মতো বিক্রি শুরু হয়।

 

জগদীশপুর চা বাগানের ইউপি সদস্য সন্তোষ মুন্ডা বলেন, আমরা প্রশাসনের সঙ্গে একাধিকবার বিষয়টি আলোচনা করেছি। কিন্তু সমস্যা হলো, এটি এখন সামাজিক ব্যাধি হয়ে গেছে। বেকার সময়, হতাশা আর দরিদ্রতা শ্রমিকদের এমন ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবে তরুনরা এইসব বাজে কাজে নেই। তারা এগুলো প্রতিরোধ করছে।

 

সামাজিক চা শ্রমিক কল্যাণ সংঘের নেতা ফিলিপন মর্মু বলেন, চা শ্রমিকদের জন্য বিকল্প বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা কর্মসূচি না বাড়ালে এভাবে মৃত্যু থামানো যাবে না। তারা জানেই না সোহাগা খাওয়া মানে ধীরে ধীরে আত্মহনন। বাগানে শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কাজের সংস্থান করতে পারলে বাগান থেকে নির্মূল করা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, এক মুঠো নেশার নেশায় চা বাগানের শ্রমিকরা নিজেদের জীবনের ইতি টানছেন। “মদের সঙ্গে সোহাগা” এখন শুধু এক রাসায়নিক মিশ্রণ নয়, এটি হয়ে উঠেছে দারিদ্র, হতাশা ও অজ্ঞতার প্রতীক। প্রশাসন, বাগান মালিক ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এখনই যদি সচেতনতা না বাড়ালে তাহলে চা বাগানগুলোতে মৃত্যুর এই মিছিল আরও দীর্ঘ হবে।

 

বাগান এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, অনেক শ্রমিক সকালে কাজে গেলেও দুপুরের পর অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকেন। কেউ কেউ আর কখনো কাজে ফিরতে পারেন না। স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ এই মদে আসক্ত হচ্ছে। এর ফলে পরিবারের নারী ও শিশুরা চরম কষ্টে জীবনযাপন করছে।

মাধবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ শহিদুল্লাহ জানান, আমরা ইতিমধ্যে তেলিয়াপাড়া চা বাগান সহ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ মদ জব্দ করেছি। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তবুও চক্রটি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমরা নিয়মিত নজরদারি রাখছি। তবে বাগানে যে কোন ধরনের মাদক নিয়ন্ত্রণে সমাজের সব মহলের সহযোগিতা সচেতনতা দরকার বেশি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments