নিজস্ব প্রতিবেদক,
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘রিকাস্টিং টিচিং অ্যাজ অ্যা কোলাবোরেটিভ প্রফেশন’; শিক্ষকতাকে একটি সহযোগিতামূলক পেশা হিসেবে পুনর্গঠন– আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিক্ষকতা নিছক জীবিকা অর্জনের উপায় নয়। এটি সহযোগিতামূলক, সমাজ পরিবর্তনের পেশা। অর্থাৎ যখন শিক্ষা প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সহকর্মী এবং সমাজের সবাই যোগ দেয়, তা হয় শিক্ষকতা। এটি শুধু পাঠদান নয়, বরং একটি সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক অভিজ্ঞতা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এ ধারণা প্রায় অনুপস্থিত। এখানে শিক্ষকতা পেশার মূল চ্যালেঞ্জগুলো হলো: সামাজিক মর্যাদা ও স্বীকৃতির অভাব, যেখানে শিক্ষকরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরও যথাযথ সম্মান পান না। ফলে মেধাবী যুবক-যুবতীরা সাধারণত এই পেশায় প্রবেশ করে না। বেতন কাঠামো ও আর্থিক সুবিধায় বৈষম্য রয়েছে। অন্য পেশা এমনকি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকের বেতন ও প্রণোদনা ভিন্ন হওয়ায় প্রেরণার ঘাটতি তৈরি হয়। পেশাগত উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত। ফলে নতুন শিখন পদ্ধতি ও শিক্ষার্থীর পরিবর্তনশীল চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়। ক্যারিয়ার অগ্রগতির সুস্পষ্ট পথ না থাকায় অভিজ্ঞ শিক্ষকরা দীর্ঘকাল একই অবস্থানে থাকেন; সারাজীবন এক পদেই থাকেন। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে দেখেছি সারাজীবন সহকারী শিক্ষক হিসেবেই চাকরি থেকে অবসরে গেছেন, পূর্ণ শিক্ষক হতে পারেননি। কর্মপরিবেশে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী, অপর্যাপ্ত শিখন সামগ্রী, সীমিত প্রশাসনিক সমর্থন ও সহায়তা মানসিক চাপ বাড়ায়।
এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বেতন ও পেশাগত উন্নয়নে সমন্বিত নীতি ও কাঠামোর অভাব এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও শিক্ষকতা পেশার বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্ব শিক্ষকতা পেশাকে মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই করতে বাধা দেয়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সমাজের নানা স্তরে পরিবর্তনের দাবি তুললেও শিক্ষক সমাজের ভাগ্যে কার্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য একাধিক কমিশন গঠিত হলেও শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠিত হয়নি। অথচ একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, মানবসম্পদ গঠন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মূল চালিকাশক্তি হলো শিক্ষা এবং এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষকতা পেশাকে মর্যাদাপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক করতে হলে অন্তত একটি সমন্বিত শিক্ষকনীতি প্রণয়নের বিকল্প নেই। শিক্ষকনীতিতে শিক্ষক নিয়োগের স্বচ্ছতা, প্রাক-চাকরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মানসম্মত প্রক্রিয়া, সর্বস্তরে সমন্বিত বেতন কাঠামো, ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ও ক্যারিয়ার অগ্রগতির স্পষ্ট পথ এবং সামাজিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি থাকতে হবে। এই নীতি থাকলে শিক্ষকরা তাদের পেশাকে শুধু চাকরি হিসেবে নয়; বরং সমাজ পরিবর্তনের কাজ হিসেবে দেখবেন।
অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ভাগাভাগি করা, পাঠদান ও গবেষণায় সমন্বয়, স্কুল, কমিউনিটি ও প্রশাসনের মধ্যে শক্তিশালী সংযোগ– এসবই সহযোগিতামূলক শিক্ষকতার মূল ভিত্তি। সরকারি-বেসরকারি ও চ্যারিটি স্কুলের সব শিক্ষক এবং শিক্ষাবিষয়ক অংশীদারকে এই সহযোগিতার মধ্যে আনা প্রয়োজন। তখন এটি হতে পারে মেধাবী তরুণদের প্রথম পছন্দের পেশা। যখন শিক্ষকতা পেশা হয়ে উঠবে পছন্দের, তখন মেধাবী যুবসমাজ শিক্ষায় আগ্রহী হবে এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষকরা সভ্যতার ধারক-বাহক, মানুষ গড়ার কারিগর; যোগ্য নাগরিক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা শুধু জ্ঞানই দেন না; শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা দিয়ে তাদের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন, যা জাতির মেরুদণ্ড গঠনে অপরিহার্য। একজন ভালো শিক্ষক হাজারো শিক্ষার্থীর জীবনে আলো জ্বালাতে পারেন।
আজকের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক– শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ও সামাজিক স্বীকৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সমন্বিত শিক্ষকনীতি ও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন, ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ক্যারিয়ার অগ্রগতি ও পদোন্নতির সুস্পষ্ট পথনকশা এবং শিক্ষকতাকে পছন্দের পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তখনই শিক্ষকরা আত্মবিশ্বাসী, প্রেরণাদায়ক এবং সহযোগিতামূলকভাবে শিক্ষাদান করতে সক্ষম হবেন। সেই শিক্ষাদানের ফলেই দেশের ভবিষ্যৎ হবে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ।