Tuesday, October 21, 2025
Homeপর্যটনরাংপানিতে ভাঙা-কাটা পাথর ফেললে ‘প্রকৃতির লাভ না, বরং বিপদ’

রাংপানিতে ভাঙা-কাটা পাথর ফেললে ‘প্রকৃতির লাভ না, বরং বিপদ’

নিজস্ব প্রতিবেদক,

 

 

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুর সীমান্তে ‘জল-নুড়ি-বড় পাথর’ জমে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া ‘অপূর্ব সুন্দর’ পর্যটনকেন্দ্র রাংপানি নদী থেকে বড় বড় পাথর লুটে নেওয়ার পর সেখানে ছোট ও ভাঙা পাথর ফেলে ‘প্রতিস্থাপন’ করেছে প্রশাসন।

 

তবে এতে ‘প্রকৃতির কোনো লাভ হবে না’ বলে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য; বরং তাতে উল্টো ফলও মিলতে পারে আশঙ্কা করছেন তারা। এতে নদীর ‘স্বাভাবিক’ পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হবে; নদীর ‘গতিপথ’ পরিবর্তন হয়ে ভাঙন দেখা দিতে পারে।

 

প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়াই এ ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে; যাতে মানুষের মধ্যে তথাকথিত ‘ইতিবাচক’ বার্তা দেওয়ারও চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য প্রকৌশল অ্যান্ড চা প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক।

 

শিক্ষার্থীদের মৃত্তিকা বিজ্ঞান সম্পর্কিত কোর্সগুলোর পাঠ দেওয়া এই শিক্ষক বলেন, “ভাঙা পাথর ফিরিয়ে দিয়ে প্রকৃতির কোনো লাভ হবে না। কারণ পাথরের একটা আয়ুষ্কাল থাকে। ভাঙার ফলে সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। ভেঙে ফেলাতে পাথরের বাইরের প্রতিরোধী আবরণ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে নানা জীব, অনুজীব পাথরের ভেতর বাসা বাঁধা শুরু করবে। এতে পাথরগুলো ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হতে থাকবে।”

 

“প্রশাসন যে পাথর ফিরিয়ে দিচ্ছে, এতে উল্টো রাংপানির পানির গভীরতা কমে যাবে। কারণ, এসব ভাঙা পাথর স্থির থাকবে না। তারা পানির গভীরে জায়গা দখল করে গভীরতা কমিয়ে দেবে।”

 

এই শিক্ষক বরং বলেন, প্রশাসন এসব ভাঙা পাথর নদীতে প্রতিস্থাপন না করে সরকারি বিভিন্ন কাজে লাগাতে পারে। তাও একটু ফলফসূ হবে।

 

গত বছরের ৫ অগাস্টের পর থেকেই ব্যাপক ‘লুটপাটের’ শিকার হয় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, ১৩৬ একরের শাহ আরেফিন টিলা, পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর এবং এর পাশের ১০ একরের রেলওয়ে বাঙ্কার, গোয়াইনঘাটের পর্যটনকেন্দ্র জাফলং ও বিছনাকান্দি, জৈন্তাপুরের লালাখাল ও শ্রীপুর-রাংপানি এলাকা।

 

এসব স্থানে স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনরাতে লুটপাট হয়েছে। ফলে পাথর-বালু ‘শূন্য’ হয়ে পড়ে পর্যটন এলাকাগুলো। আর ‘খানাখন্দে’ পরিণত হয়েছে রেলওয়ে বাঙ্কার ও শাহ আরেফিন টিলা। এতে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে লুটেরা চক্র।

 

প্রশাসনের তথ্যমতে, সারাদেশে পাথর ও বালু উত্তোলনের নির্দিষ্ট ৫১টি কোয়ারি আছে। সিলেটের কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে আছে আটটি কোয়ারি। এর বাইরে সিলেটের সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়াসহ আরও ১০টি জায়গায় পাথর-বালু আছে। এসব জায়গা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

 

সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি নদী থেকে এসব পাথর-বালু আসে। ২০২০ সালের আগে সংরক্ষিত এলাকা বাদে সিলেটের আটটি কোয়ারি ইজারা দিয়ে পাথর উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। তবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির কারণে ২০২০ সালের পর আর পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হয়নি।

 

ভারসাম্য ফিরবে দলগত উদ্যোগে,

 

সমালোচনার মুখে প্রশাসন যখন সিলেটের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ‘সাদাপাথর ও জাফলংয়ের’ লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে উদ্যোগী হয়েছে, ঠিক তখনি জৈন্তাপুর উপজেলার ‘রাংপানি’ পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুটের বিষয়টিও সামনে এসেছে। আশির দশকে এই রাংপানি পর্যটনকেন্দ্রে অনেক চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে।

 

যদিও রাংপানিতে পাথর লুট চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। তবে গত বছরের ৫ অগাস্টের পর থেকে বেড়েছে লুটপাট। বর্তমানে সীমান্তের ওপারে গিয়ে শ্রমিকেরা পাথর তুলে নিয়ে আসছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, লুটেরাদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অসৎ’ লোকজনও জড়িত।

 

সিলেট নগরীর বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন গত বছরের শেষ অগাস্টে গিয়েছিলেন রাংপানি পর্যটনকেন্দ্র দেখতে। তার ভাষ্য, “রাংপানি তখন দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। বড় বড় পাথর পানিতে ভেসে রয়েছে। পাশে মেঘালয়ের সারি সারি পাহাড়, সুপারির বাগান, পাহাড়ি গাছপালা আর ঝর্না দেখে মনে হয়েছিল এ যেন প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য। এই জায়গার পাথর নিয়ে গেছে শুনে খারাপ লাগছে।”

 

মঙ্গলবার থেকে প্রশাসন রাংপানি নদীতে পাথর প্রতিস্থাপন করা শুরু করেছে। অভিযানে উদ্ধার হওয়া বড় বড় পাথর, কাটা ও ভাঙা পাথর ওইখানে নিয়ে ফেলা হচ্ছে। তবে কাজটির ক্ষেত্রে প্রশাসন কারও পরামর্শ নেয়নি।

 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জৈন্তাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার লাবনী বলছিলেন, “পাথর যাতে চুরি না হয়, এজন্যই নদীতে সংক্ষরণ করা হচ্ছে। রাংপানি নদীর পুরো তলদেশে পাথর রয়েছে, এজন্য নিয়ে রাখা হচ্ছে।”

 

তিনি আরও জানান, বুধবার জৈন্তাপুরের বিভিন্ন বালু মহালে সাইনবোর্ড টাঙানো হচ্ছে। বালু না তোলার বিষয়ে।

 

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, “মাটির গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাথরের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পাথর সরিয়ে নেওয়ায় বালি, অনুজীব ও পাথরের প্রাকৃতিক আন্তঃসম্পর্ক ভেঙে গেছে। এতে পরিবেশের যে ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, তা পুরোপুরি ফেরানো সম্ভব নয়।”

 

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শাহিদুর রহমান বলেন, রাংপানি এলাকা থেকে উত্তোলন করা পাথর ফেরত দেওয়া হলেও প্রকৃতির যে ক্ষতি হওয়ার, তা এরই মধ্যে হয়ে গেছে। প্রকৃতি নিজস্ব ছন্দে চলে এবং এর প্রতিটি উপাদান পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে একটি অংশে হস্তক্ষেপ করলে পুরো ব্যবস্থার ওপর প্রভাব পড়ে, যা সহজে পূরণ করা সম্ভব নয়।

 

“পাথরগুলো ভাঙার ফলে সে তার স্বাভাবিক গঠন ও গুণাগুণ হারিয়ে ফেলেছে। তাই ফেরত দিলেও তা প্রকৃতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে পারবে না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন পাথর গঠিত হওয়া এবং পুরনো পাথরের সঙ্গে মিশ্রণের মাধ্যমে প্রকৃতি ধীরে ধীরে ভারসাম্য ফিরে পেতে পারে।”

 

শিক্ষক শাহিদুর রহমান বলেন, এজন্য প্রয়োজন প্রশাসনের কার্যকর নজরদারি এবং প্রকৌশলী, পরিবেশবিদ ও সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি দলগত উদ্যোগ, যাতে এসব এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব হয়।

 

‘পাথর ফেলে গলদঘর্ম হওয়ার চেয়ে লুট ঠেকানো সহজ ছিল’

 

পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’ (ধরা) আজীবন সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, “সাদাপাথর, রাংপানিসহ সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাথর লুটের পর প্রশাসন পাথর উদ্ধার এবং প্রতিস্থাপন করছে। এটা অনেকের বাহবা কুড়িয়েছে। এটা করতে গিয়ে প্রশাসন যে গলদঘর্ম হচ্ছে, তার চেয়ে লুট ঠেকানো ছিল অনেক সহজ। উদ্ধার হওয়া কাটা বা ভাঙা পাথর রাংপানিতে প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে করা উচিত ছিল।”

 

তিনি বলেন, “পানির স্রোতের সঙ্গে উজান থেকে গড়িয়ে আসা পাথর সনাতন পদ্ধতিতে বারকি নৌকায় করে উত্তোলন পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি করে না। এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমরা এর বিপক্ষে নই। কিন্তু এক্সাভেটর ও বোমা মেশিনের মাধ্যমে মাটি খুঁড়ে ভূ-গর্ভস্থ পাথর উত্তোলন পরিবেশ, পর্যটনকেন্দ্র ও নদীর ধ্বংস ডেকে আনছে। রাংপানিতেও তা ঘটছে।

 

“দীর্ঘদিন ধরে থাকা বিশাল আকৃতির পাথরগুলো একটা শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে ছিল। উদ্ধার হওয়া পাথর কি মাটির গভীরে প্রতিস্থাপন সম্ভব? এগুলো কি আগের মতো শক্ত কাঠামোয় আবার ফিরে যাবে? মোটেই না। মূলতঃ এলোপাতাড়িভাবে কাটা বা ভাঙা পাথর নদীতে ফেলে নদীর আরও সর্বনাশ ডেকে আনা হচ্ছে। এতে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হবে; নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে ভাঙন দেখা দিতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।”

 

তবে পানি উন্নয়র বোর্ড-পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, “এটা আমাদের কোনো বিষয় না।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments