নিজস্ব প্রতিবেদক,
মাছ-শুটকি থেরেক শুরু করে কাপড়, মশারি, হাতঘড়ি কী নেবই এখানে? শাক-সবজি, পান-সুপারি, মোবাইল সিম, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, চার্জার, খেলনা- সবই আছে। মনে হতে পারে এটি কোন বাজার। কিন্তু আদতে এটি বাজার নয়, সেতু। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যান চলাচল বন্ধ করে কিনব্রিজ কেবল পথচারীদের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিলো৷ কিন্তু এই সেতুতেই এখন পথচারিদের চলাচল করা দায়। প্রায় পুরো সেতুই এখন হকারদের দখলে।
পথচারীদের মতে, এটি এখন আর কিনব্রিজ নয়, যেন কিন বাজারে পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিন প্রায় শ’খানেক হকার বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে ব্রিজের দুইপাশে বসেন। ব্রিটিশ আমলে সিলেটের সুরমা নদীতে নির্মিত কিনব্রিজের ওপর অবৈধভাবে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট বসিয়েছেন তারা। অনেক পথচারী পণ্য কেনা বা দরদাম করতে গিয়ে জটলা পাকান বিক্রেতাদের কাছে। ফলে সেতু দিয়ে হাটাচলায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় পথচারীদের। বিশেষত নারী পথচারীদের পড়তে হয় অস্বস্থকির অবস্থায়। গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে চলতে হয় তাদের।
পথচারীদের অভিযোগ, কিন্তু সেতুর একাংশ দখল করে হকাররা দোকানপাট বসানোর কারণে মানুষ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে না। তবে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, হকারদের উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। তবু তারা আবার দোকানপাট বসান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেতুর দুই পাশ দখল করে কয়েক শ’ হকার নানা ধরণের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। সেসব পণ্য দরদাম করে কিনছেন অসংখ্য ক্রেতা। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে সেতুর উত্তর থেকে দক্ষিণাংশের শুরুর বাঁ পাশে তুলনামূলকভাবে ভিড় বেশি। ওই অংশে জটলাও বেশি।
কিনব্রিজ ব্যবহারকারী কদমতলী এলাকার ব্যবসায়ী মোবাশ্বির আহমদ বলেন, হকারদের উৎপাতে এই ব্রিজ দিয়ে হাঁটা মুশকিল হয়ে গেছে। ব্রিজ পার হওয়ার সময় হকাররা ডাকাডাকি করে। অনেকই এই হকারদের সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকেন। যার ফলে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্রিজটি ব্যবহার করা যায় না। যত দিন যাচ্ছে হকারদের উৎপাত বাড়ছে।
দক্ষিণ সুরমার ভার্তখলা এলাকার বাসিন্দা আনসার উদ্দিন বলেন, ব্যস্ত একটি সেতুর ওপরে হকাররা এভাবে দেদারসে দোকানপাট বসালেও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ তাদের উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। অথচ পথচারীদের নিয়মিত দুর্ভোগ সহ্য করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। হকাররা সেতুর একাংশ দখল করে রাখায় যান চলাচলের পথও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
সেতুর আশপাশের এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, সেতুতে অস্থায়ী দোকানপাট থাকায় ময়লা-আবর্জনাও ছড়িয়ে পড়ছে সেতুতে। এ ছাড়া সেতুর প্রকৃত সৌন্দর্যও আড়াল হয়ে যাচ্ছে। সেতুর দক্ষিণাংশে সিলেটের সবচেয়ে বড় বাসস্ট্যান্ড কদমতলী বাস টার্মিনাল ও সিলেট রেলস্টেশন। এ সেতু দিয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা মানুষের উত্তরাংশে; অর্থাৎ মূল শহরে ঢুকতে হয়। তাই সেতুটি হকারদের দখলে থাকায় বিষয়টি পর্যটকদের কাছেও নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে বলে অনেকে মতামত দেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, সেতু থেকে প্রায়ই হকারদের উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু সরিয়ে দেওয়ার পরও তারা আবার সেখানে দোকানপাট বসান। এখন বিষয়টি আরও কড়াকড়িভাবে দেখা হবে বলে তিনি জানান।
জানা যায়, কিনব্রিজ সিলেটের সুরমা নদীতে স্থাপিত প্রথম সেতু। ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৩ সালে লোহার কাঠামোয় দৃষ্টিনন্দন সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। আসাম প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কিনের নামে এই সেতুর নামকরণ হয় কিনব্রিজ। ১৯৩৬ সালে সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
সেতুটি প্রায় আট দশক ধরে সচল ছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেতু কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সংস্কারকাজ শেষে আবারও সচল হয় কিনব্রিজ। নব্বই দশকের পর সিলেটে সুরমা নদীর ওপর আরও চারটি সেতু নির্মাণ করা হয়। কিনব্রিজ সিলেট নগরের মধ্যভাগে হওয়ায় যানবাহন চলাচল কখনো বন্ধ হয়নি। লোহা দিয়ে তৈরি কিনব্রিজের আয়তন হচ্ছে ১,১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ ফুট প্রস্থ ।
ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই কিনব্রিজে যান চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল। এরপর সংস্কার কাজ শেষে ওই বছরের ডিসেম্বরে সেতু চালু করা হলেও যান চলাচল বন্ধ করে কেবল পদচারী সেতুতে রূপান্তর করা হয়।