নিজস্ব প্রতিবেদক,
শ্রীলংকায় চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি সাড়ে পাঁচশ টাকার মতো। চা উৎপাদনকারী দেশ কেনিয়া ও ভারতে তা যথাক্রমে ৪৮৩ ও ২৫৬ টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রতিজন শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে পান ১৭৯ টাকা। মূলত অন্য দেশগুলোর তুলনায় নিম্নমানের ক্লোনের কারণে বাংলাদেশে পানীয় পণ্যটির উৎপাদন ব্যয় হয় অনেক বেশি, যার প্রভাব পড়ছে শ্রমিকের মজুরিতে। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাওয়ায় ক্রমান্বয়ে কমছে এ খাতের প্রায় দেড় লাখ শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান।
চা শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের দিকে দেশে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল ৮৫ টাকা। আন্দোলনের পর সেটি বাড়িয়ে ১০২ টাকা এবং পরবর্তী সময়ে ১২০ টাকা করা হয়। ২০২২ সালে বৃহৎ শ্রমিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ১৭০ টাকা। এরপর সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বছর ৫ শতাংশ হিসেবে মজুরি বাড়ছে। এখন শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি পাচ্ছেন ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। আগামী আগস্টে মজুরি আরো ৫ শতাংশ বৃদ্ধির কথা রয়েছে। একই সঙ্গে শ্রমিকরা প্রতি সপ্তাহে ৩ দশমিক ৩ কেজি ভর্তুকি মূল্যে আটা বা চাল পান বাগান মালিকের কাছ থেকে (প্রতি কেজি ২ টাকা হারে)। এছাড়া বাগানের বাসস্থান, কৃষিজ জমি, স্কুল, প্রাথমিক চিকিৎসা, বোনাসসহ বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন শ্রমিকরা। কিন্তু দেশীয় বাস্তবতায় চা শ্রমিকদের জন্য দেয়া এসব সুবিধা খুবই নগণ্য বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিক নেতারা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, ‘একজন চা শ্রমিক দৈনিক যে মজুরি পান সেটি খুবই নগণ্য। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে সুবিধা পাওয়ার কথা তার সঙ্গে চা শ্রমিকদের মজুরি ও সুবিধার কোনো মিল নেই। মালিকরা সবসময় চায়ের দাম কম থাকার কারণে মজুরি ও সুবিধা বাড়াতে পারছেন না বলে জানান। কিন্তু শ্রমিকরা কাজে ফাঁকি না দিয়ে বাগানে শ্রম দেন। উৎপাদিত চায়ের ন্যায্যমূল্য না পেলে তাতে শ্রমিকের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। উৎপাদন খরচ কমিয়ে বাগানকে লাভজনক করার মাধ্যম শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতে সরকারের এ বিষয়ে কাজ করা উচিত।’
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবস্থাপনা জটিলতা, প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে নিলামগুলোয় চায়ের দাম আশানুরূপ না হওয়ায় বাগানগুলো টিকে থাকার প্রয়োজনে কৃচ্ছ্রতা দেখাচ্ছে শ্রমিকের মজুরিতে। এতে নিরবচ্ছিন্নভাবে চা উৎপাদনে সম্পৃক্ত থাকা মানুষগুলোর জীবনের পরিবর্তন ঘটছে খুবই কম। বছর বছর মাত্র ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি আর নামমাত্র মূল্যের সাপ্তাহিক রেশন কিংবা বাসস্থানসহ অপ্রতুল শিক্ষা-চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে অনিশ্চিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক চা শ্রমিক।
বাংলাদেশে চা উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে হেক্টরপ্রতি উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা। বাংলাদেশ চা বোর্ডের অধীনে একটি চা গবেষণা কেন্দ্র থাকলেও এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদনসংবলিত কোনো চায়ের জাত উদ্ভাবন করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে বিশ্বে এখন হেক্টরপ্রতি (বছরে) ১০ হাজার কেজি পর্যন্ত চায়ের ক্লোন জাত উদ্ভাবন হলেও বাংলাদেশে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় তিন হাজার কেজি। এ কারণে শ্রমিক বাগানে তার শ্রম দিয়ে গেলেও উৎপাদন খরচ কমাতে তার কোনো ভূমিকা থাকে না। যদিও বাগান মালিক কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, চায়ের মূল্য ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় মজুরি বাড়তি দেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা বোর্ডের সাবেক উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ বলেন, ‘চায়ের মান বৃদ্ধি ও হেক্টরপ্রতি উৎপাদন খরচ কমাতে না পারলে বাগানগুলো কোনোভাবেই শ্রমিককে বাড়তি মজুরি দিতে পারবে না। ভারত, শ্রীলংকা, কেনিয়াসহ প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়েও ভালো মানের চা উৎপাদন করে শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। আমরা কেন শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে পারছি না সেসব বিষয়ে কেউই গভীর অনুসন্ধান করছে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকরা মাঠে কাজ করছেন ঠিকই, কিন্তু ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোর সমপরিমাণ বাগান থেকে অর্ধেকেরও কম চা উৎপাদন করছেন। এতে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভুক্তভোগী হচ্ছেন আমাদের মাঠে রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট করা শ্রমিকরাই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথ গবেষণা, চুক্তি কিংবা বৈজ্ঞানিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে চায়ের মান বৃদ্ধি, খরচ কমাতে উৎপাদন বাড়ানোসহ নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। চা বোর্ডকে ঢেলে সাজানো ছাড়া চা খাত ও শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।’
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের চা খাতের উন্নয়নে গবেষণায় কাজ করছে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। চা বোর্ডের অধীন প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ২৩টি ক্লোন ও পাঁচটি বীজ জাত উদ্ভাবন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ ক্লোন চা উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে হেক্টরপ্রতি তিন হাজার কেজি। যদিও বর্তমানে ভারতের (সর্বভারতীয়) ক্লোনগুলোর সর্বোচ্চ উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার কেজি। দক্ষিণ ভারতের উদ্ভাবিত ক্লোনগুলোর হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৮-১০ হাজার কেজি। এভাবে কেনিয়া ছয় হাজার ও শ্রীলংকা পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কেজি চা উৎপাদনে সক্ষম। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অর্ধেকেরও কম চা উৎপাদনে সক্ষম হওয়ায় বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যার সরাসরি ভুক্তভোগী হচ্ছেন চা শ্রমিকরা।
বাংলাদেশী চা সংসদের সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান বলেন, ‘আমাদের চা উৎপাদন খরচ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সে তুলনায় নিলামে দাম পাওয়া যাচ্ছে না। বেশির ভাগ মালিকই লোকসান দিয়ে চা বিক্রি করছেন। শ্রমিকের বেতন-ভাতা ও সুবিধা দিতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। কেন আমরা পিছিয়ে পড়ছি, নিলামে কেন চায়ের দাম উঠছে না সে বিষয়ে আমাদের করণীয় নির্ধারণে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়, সংস্থাকে বারবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো অভিযোগ কিংবা উদ্যোগেই দেশের চা খাতের এ সংকট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না।’
শ্রমিকদের কম মজুরির বিষয়ে তিনি ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির পাশাপাশি শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, রেশনসহ নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি বছর নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্ধারণ করা পদ্ধতিতে চা শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে। দৈনিক মজুরিকে প্রাধান্য না দিয়ে সার্বিক হিসাব বিবেচনা করলে বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা আগের তুলনায় ভালো সুবিধা পাচ্ছেন।’
দেশে বর্তমানে চা বাগানের সংখ্যা ১৭০। এছাড়া উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্রায়তন চাষী ছাড়াও সারা দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামেও চা চাষ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এসব খাতে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করেন ৯৭ হাজার স্থায়ী শ্রমিক। এছাড়া প্রতি বছর চা চাষের সঙ্গে অস্থায়ীভাবে আরো ৪০-৫০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সব মিলিয়ে দেশে চা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার। প্রতি বছর চা চাষ বৃদ্ধির পাশাপাশি চা খাতকে সুরক্ষা দিতে প্রায় এক দশক ধরে চা আমদানিতে কঠোর শুল্কারোপ করেছে সরকার। নিয়ন্ত্রণমূলক পদ্ধতি চালু হলেও চা গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে না পারায় পিছিয়ে পড়ছে খাতটি। এতে সবচেয়ে বেশি নাজুক ও সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন খাতটির অন্যতম অংশীদার চা শ্রমিকরা।