নিজস্ব প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জের হাওরজুড়ে এখন সোনালি ধানের হাসি। বোরো মৌসুমে মাঠ ভরে উঠেছে পাকা ধানে, বাতাসে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন। চলতি মৌসুমে জেলার ১২ উপজেলার ১৩৭টি ছোট-বড় হাওরে বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে। বাস্তবে চাষ হয়েছে তার চেয়েও বেশি—২ লাখ ২৩ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮০ মেট্রিক টন, যার বাজার মূল্য আনুমানিক ৫ হাজার ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
পরিসংখ্যান বলছে—এ যেন এক সাফল্যের গল্প। কিন্তু এই সাফল্যের নেপথ্য নায়ক, ভাসমান গ্রামের বর্গাচাষিদের ভাগ্যে এখনও নেই সোনালি আলোর ছোঁয়া।
হাওরের বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ভাসমান বসতিগুলোতে ছয় থেকে আট মাস ধরে বসবাস করেন কয়েকশ পরিবার। এদের সবাই বর্গাচাষি—যাদের নিজের জমি নেই, কিন্তু অন্যের জমিতে ফসল ফলিয়ে জীবনধারণ করেন। সময়মতো বীজ বোনা থেকে শুরু করে কোমরভেজা পানিতে দিনরাত পরিশ্রম করেও মৌসুম শেষে ঘরে ফেরেন ফাঁকা হাতে।
সুনামগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বড় হাওরের মাঝেই আছে এমন কিছু ভাসমান গ্রাম। ঠিক তেমনি একটি গ্রাম ‘কলাবাড়ি’। হাওরের মাঝখানে ছবির মতো সাজানো এই গ্রামে প্রতিটি গৃহেই লেখা কৃষকের হাসি-কান্নার গল্প।
কলাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা দিলিপ দাস বলেন, আমরা দিনের পর দিন হাওরের মধ্যে থেকে কাজ করি, কিন্তু ধান ওঠে জমির মালিক আর মহাজনের ঘরে। আমাদের ভাগে যা থাকে, তাতে সংসার চলে না। আমাদের ঘামে জমি সোনালি হয়, কিন্তু হাতে ধরা যায় না সে সোনা।
গ্রামটিতে ১৫টি পরিবার বাস করে— ১২টি হিন্দু, ৩টি মুসলমান। ধর্মের ভেদাভেদ নেই, আছে শুধুই বেঁচে থাকার এক চিলতে লড়াই। নেই বিদ্যুৎ, নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। ঝড়ের রাতে খড়কুটোর ঘরে কাঁপা কাঁপা ঘুম, দিনের বেলায় ক্লান্ত শরীরে হাওরে শ্রম—এটাই তাদের জীবনচিত্র।
সীমা রানি দাস বলেন, আমরা মেয়েরা রান্না করি, ধান শুকাই। পুরুষেরা হাওরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। বছরের শেষে হিসাব করলে দেখা যায়, আমাদের কিছুই থাকেনা।
আরেক বাসিন্দা দীপেন্দ্র দাস বলেন, ধান উঠলেও আমাদের চোখে জল থাকে। বাজারে ধানের দাম বাড়ে, কিন্তু আমাদের লাভ হয় না। বরং দেনা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়।
এই চাষিরাই বীজ বোনেন, ধান রোপণ করেন, বজ্রঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফসল রক্ষা করেন। অথচ মৌসুম শেষে তাদের ঘরে আসে না খুশির বাতাস—বরং আসে ঋণের হিসাব, হতাশা আর অনিশ্চয়তা।
হাওরের ফসল নিয়ে যতই আশার আলো জ্বলুক, সেই আলো এখনো এসে পৌঁছায়নি ভাসমান গ্রামের এই বর্গাচাষিদের কপালে। ধানের মাঠে ঘাম ঝরে তাদের, কিন্তু ফসল ওঠে অন্যের ঘরে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, বর্গাচাষিরা সরাসরি ফসল বিক্রির সুযোগ কম পান। তাদের লাভ যাতে হয় তার জন্য আমরা কাজ করছি। আমরা তাদের মধ্যে বীজ ও সার সহায়তা দিয়ে থাকি। তবে কাঠামোগত সমস্যার কারণে তারা প্রকৃত লাভবান হতে পারেন না। এ ছাড়াও আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের জীবন-মন উন্নয়নের জন্য কাজ করছি।