Thursday, March 20, 2025
Homeসিলেট বিভাগমৌলভীবাজারমৌলভীবাজারে বাগানে বাগানে চা পাতা তোলা শুরু, চা শ্রমিকের মুখে হাসি

মৌলভীবাজারে বাগানে বাগানে চা পাতা তোলা শুরু, চা শ্রমিকের মুখে হাসি

নিজস্ব প্রতিনিধি,

 

“চা উৎপাদন প্রকৃতিনির্ভর। সারা বছর যেন হাত ভরে পাতা তুলতে পারি, তাই বাগানের ম্যানেজম্যান্ট ও শ্রমিক মিলে ভগবানের নামে পূজা দিয়ে পাতা তোলা শুরু করেছি,” বলছিলেন ন্যাশনাল টি কোম্পানির মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ পদ্মছড়া চা বাগানের শ্রমিক বিজয়া গোয়ালা।

 

তার মত মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিকদের মুখে এখন খুশির হাসি। তিন মাস গাছে প্রুনিং (ছাঁটাই) শেষে বৃষ্টির ছোঁয়ায় নতুন কুঁড়ি এসেছে; ফিরছে সবুজের সমারোহ।

 

সাধারণত ডিসেম্বরে মৌসুমের শেষে গাছ ছাঁটাই বা কলমের পর নিয়ম অনুযায়ী দুই-তিন মাস বাগানে পাতা উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ সময় চা কারখানাগুলোতেও কাজ থাকে না। সেচ ও বৃষ্টির পর নতুন কুঁড়ি গজালে আনুষ্ঠানিকভাবে চা পাতা তোলার কাজ শুরু হয়। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি।

 

সরেজমিনে দেখা গেছে, চা পাতা তোলার আগে বাগানগুলোতে বাগান কর্তৃপক্ষ ও পঞ্চায়েত নেতাদের উপস্থিতিতে শ্রমিকরা পূজা-অর্চনা, গীতাপাঠ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা করেন। এরপর নাচে-গানে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন তারা।

 

দেশের ১৬৮টি চা বাগানে চলতি অর্থবছর ১০ কোটি ৩০ লাখ কেজি (১০৩ মিলিয়ন কেজি) চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইসমাইল হোসেন জানান।

 

অবশ্য আবহাওয়া অনূকুলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ‘বেশি’ উৎপাদন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

 

তারা বলছেন, চা প্রকৃতি নির্ভর কৃষিজ পণ্য। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চায়ের উৎপাদন ভালো হয়। এর জন্য প্রয়োজন পরিমিত বৃষ্টি ও সূর্যের কিরণ। মার্চের শুরুতে কিছু বৃষ্টি হওয়াতে, কিছু ছাঁটাই করা চা গাছে নতুন কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে।

 

উৎপাদন মৌসুম শুরু হওয়ায় চা বোর্ড থেকে ‘মানসম্মত’ চা তৈরির জন্য বছরজুড়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

 

চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, ২০২৩ সালে ১০৩ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। আর ২০২৪ সালে উৎপাদন হয়েছিল ৯৩ মিলিয়ন কেজি চা; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ কম ছিল। দেশে নিবন্ধন করা ১৬৮টি চা বাগান রয়েছে। পাশাপাশি পঞ্চগড়ে রয়েছে ক্ষুদ্রায়িত অনেকগুলো চা বাগান।

 

চা শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চায়ের উৎপাদন বাড়াতে চা গাছে প্রুনিং (ছাঁটাই) এর বিকল্প নেই। এর ফলে চা গাছে নতুন পাতা গজায়। চা সংশ্লিষ্টদের কাছে চা গাছের পাতাই হচ্ছে ‘সোনা’। এটাকে অনেকে ‘সবুজ সোনাও’ বলেন।

 

চা গাছের ছাঁটাইয়ের চারটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপ হলো ‘লাইট প্রুনিং’ (এলপি) যেখানে আটটি পাতা রেখে কুঁড়ি তুলতে হয়। দ্বিতীয় ধাপ হলো ‘ডিপ স্কিপ’, এ পদ্ধতিতে গাছে তিনটি পাতা রেখে কুঁড়ি তুলতে হয়। তৃতীয় ধাপ হলো ‘মিডিয়াম স্কিপ’। মিডিয়াম স্কিপে গাছে দুটি পাতা রেখে কুঁড়ি তুলতে হয়।

 

আর ‘লাইট স্কিপ’- পদ্ধতিতে একটি পাতা রেখে কুঁড়ি তুলতে হয়। এই স্কিপগুলোরও আবার ধাপ রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেক গাছেই এই নিয়মে ছাঁটাই করতে হয়।

 

কমলগঞ্জ শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগানের শ্রমিক আশালতা বলেন, তাদের বাগানে ডিসেম্বরে চা গাছ প্রুনিং করা হয়। ওই সময়ে বৃষ্টি ছিল না। বিকল্প ব্যবস্থায় ইরিগেশন করা হয়েছে। আর মার্চের শুরুতে অল্প কিছু বৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে মার্চ মাসেই চা গাছে পাতা আসতে শুরু করেছে। এরপর মালিক এসে সবাইকে নিয়ে মিলাদ মাহফিল করার পর, এখন তারা পাতা তুলছেন।

 

মাধবপুর চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক তাপস কুণ্ড বলেন, মৌসুমের একেবারে শুরু থেকেই তারা নতুন কুঁড়ি পেয়েছেন। চায়ের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির পাশাপাশি প্রকৃতির ওপরও নির্ভর করতে হয়। চায়ের জন্য মূলত প্রয়োজন পরিমিত বৃষ্টিপাত ও সূর্যের আলো। বর্ষায় অতি বৃষ্টিপাত চায়ের জন্য ক্ষতিকর। আবার প্রচণ্ড তাপদাহও ক্ষতিকর। যে কারণে এর জন্য কিছুটা প্রকৃতির উপর নির্ভর করতেই হয়।

 

শ্রীমঙ্গল জেরিন চা বাগানের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সেলিম রেজা বলেন, “বাগানে পাতা চয়নের কাজ শুরু হওয়ায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরছে। বিগত বছর প্রকৃতিগত কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮ থেকে ১০ পার্সেন্ট ঘাটতি ছিল। তবে এ বছর এই ঘাটতি পূরণ হবে, আশা করছি।”

 

লক্ষ্য মানসম্মত চা তৈরি:

 

শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগানের মালিক ও ন্যাশনাল টি কোম্পানির পরিচালক মো. মহসীন মিয়া মধু বলছিলেন, তিনি তার বাগানের চা গাছগুলোকে সন্তানের মতো পালন করেন। এজন্য তার বাগানে হেক্টর প্রতি উৎপাদন আশাব্যাঞ্জক। মার্চের শুরুতেই তার বাগানে উৎপাদন শুরু হয়েছে। ‘কোয়ালিটিফুল’ চা তৈরি এ বছর তার মূল লক্ষ্য।

 

চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান গোলাম মো. শিবলী বলেন, “খরা চায়ের বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। খরার সময় বৃষ্টি পাওয়া যায় না। এতে গাছ মরে যায়; বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দেয়। এ সময়ে চা সংশ্লিষ্টদের খুব সর্তক থাকতে হয়।

 

“একটি চা গাছ বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবাইকে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কারণ, এক-একটি চা গাছ শ্রমিক, ম্যানেজার ও স্টাফদের জীবন।”

 

বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক রফিকুল হক বলেন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও কোয়ালিটিফুল চা তৈরির জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান বছরজুড়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা দিয়েছেন। বছরজুড়ে তারা তা বাস্তবায়ন করবেন।

 

বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন বলেন, “পানির পর বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় হচ্ছে চা। এই চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই আমাদের দেশের মানুষের দিনের শুরু। এটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসলে রূপ নিয়েছে। ফলে এই ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুণগতমান রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments