দোয়ারাবাজার সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় ভুয়া বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চারজন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের শাসনামলে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালার নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই দূর্ণীতির মাধ্যমে উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় চারজন প্রভাষক নিয়োগ দিয়েছেন ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সৈয়দ হোসেন কবির ও তৎকালীন গভর্নিংবডির সভাপতি হাসমত উল্লাহ।
উপজেলা প্রশাসনের তদন্তে দূর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরেও চাকুরিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির ও তাঁর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত চার শিক্ষক। বেতন ভাতাসহ প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছেন তাঁরা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বরইউড়ি মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বলছেন, মোট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অধ্যক্ষ ও সভাপতি মিলে গোপনে চার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এব্যাপারে একাধিকবার অভিযোগ দেওয়া হলেও কেবলমাত্র তদন্ত করেই দায় এড়ানো হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির ও তাঁর মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উল্টো তাদেরকে চাকুরিতে বহাল রেখে পুরষ্কৃত করা হচ্ছে।
মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগের কাগজপত্র অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় ২০১৫ সালে চারজন প্রভাষককে কাগজপত্রে নিয়োগ দেখিয়ে ২০২৪ সালে এমপিও করা হয়। তাঁরা হলেন আরবি প্রভাষক মাহবুবুর রহমান, বাংলা প্রভাষক মাহমুদুল হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভাষক মুজিবুর রহমান ও ইংরেজি প্রভাষক আব্দুছ ছালাম। অথচ ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে কোনো নিয়োগই হয়নি। এমনকি ২০২৪ সালের আগে এই চারজন প্রভাষক একদিনও মাদ্রাসায় পাঠদান করেননি এবং তাদেরকে এলাকার কেউ আগে কখনো দেখেওনি।
অথচ এই চারজনের নিয়োগকে বৈধতা দিতে গিয়ে অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির পত্রিকায় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়াই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অধ্যক্ষের পছন্দের এই চার শিক্ষককে নিয়োগ দিতে গিয়ে নিয়োগ কমিটির নামেও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষক নিয়োগের ফলাফল সিটে নিয়োগ পরীক্ষার সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় দেখানো হয়েছে ২০১৫ সালের ১৭ মে। এই ফলাফল সিটে নিয়োগ কমিটির স্বাক্ষরে কলাউরা দারুসসুন্নাত কাশেমিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে রফিকুল ইসলামের সাক্ষর দেখানো হয়েছে।
অথচ এর দুইবছর আগে ২০১৩ সালে রফিকুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ২০১২ সালে অধ্যক্ষ পদ থেকে তিনি অবসরে গেছেন। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে মারা যাওয়ার দুইবছর পর ২০১৫ সালে শিক্ষক নিয়োগের ফলাফল সিটে কলাউরা দারুসসুন্নাত কাশেমিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে রফিকুল ইসলামের সাক্ষর আসলো কিভাবে?
সরেজমিনে বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবিরের মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া চার শিক্ষক ও এক কর্মচারী এখনো পর্যন্ত চাকুরিতে বহাল রয়েছেন। তদন্তের সময় দুইমাস তাদের বেতন ভাতা বন্ধ থাকলেও অদৃশ্য কারণে গত ডিসেম্বর মাস থেকে বেতন ভাতা পুনরায় চালু হয়েছে।
সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন এই চার শিক্ষক। পরে এদের মধ্যে দুজন শিক্ষকের মুখোমুখি হলে তারা জানান, ইউএনও’র কাছে অনুরোধ করে বেতন চালু করেছেন। তবে এবিষয়ে আর কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তাঁরা।
মাদ্রাসার গভর্নিংবডির সাবেক সভাপতি হাসমত উল্লাহ বলেন, ‘আমি সভাপতি থাকাকালীন হঠ্যাৎ চারজন শিক্ষক তাদের বিল সই করানোর জন্য আমার কাছে আসে। আমি উনাদের কাউকেই চিনতাম না এবং এর আগে কখনো মাদ্রাসায় দেখিনি। মাদ্রাসায় না এসে, পাঠদান না করে কিভাবে বিল তুলতে আসলো তা নিয়ে আমার শুরু থেকেই সন্দেহ হয়। আমি সই না দিলে তাদের বিলে সই দিতে আমাকে জোড়ালো ভাবে অনুরোধ করেন প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবির। এরপরই আমার সন্দেহ আরো বেড়ে যায়।
পরবর্তীতে আমি ছয়মাস তাদের বিল আটকে রাখি। কিন্তু ওই চার শিক্ষক এসে আমার হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেন এবং প্রিন্সিপাল ও কমিটির সদস্যদের চাপে শেষ পর্যন্ত তাদের বিলে সাক্ষর করি। তাদের কাছ থেকে আমি কোনো টাকা পয়সা গ্রহণ করিনি। তবে মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য মাদ্রাসার ফান্ডে তারা চারজন ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়েছিলো আমাদের অনুরোধে। আমি জানতাম এনটিআরসির মাধ্যমে তাদের নিয়োগ হয়েছে। ভুয়া বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাদের চাকুরি হয়েছে জানলে আমি তাদের বিলে সই করতাম না।’
মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চলছে। আমি অসুস্থ।’
ভুয়া বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কিভাবে শিক্ষক নিয়োগ হলো জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে কলে কেটে দেন। এরপরে একাধিক বার কল দেওয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতি ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নেহের নিগার তনু জানান, ‘অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করে প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবিরের অনিয়ম ও দূর্নীতির প্রমাণ পেয়েছি। তাঁর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশ করেছি। তাঁরা বিষয়টি দেখবে। তদন্তের সময় শিক্ষকদের বেতন বন্ধ রেখেছিলাম। তদন্ত শেষ তাই বেতন পুনরায় চালু করেছি।’
সুনামগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ‘প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবিরের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দূর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ তদন্তের রিপোর্ট এখনো চলমান। এই রিপোর্ট হাতে আসার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর ভুয়া বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধেও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’