স্কোরবোর্ড অনুযায়ী আফগানিস্তানের দরকার ছিল ৩৩৫ রান। আর বাংলাদেশের জন্য লক্ষ্য ছিল ২৭৯ রানেই অলআউট করা। ৩৩৪ রানের বড় সংগ্রহের পর সমীকরণ ছিল সহজ।
এশিয়া কাপের সুপার ফোরে যেতে হলে বাংলাদেশকে জিততে হবে ৫৫ কিংবা তারচেয়ে বেশি রানের ব্যবধানে। হাতের নাগাল থেকে প্রায় ছুটে যাওয়া ম্যাচে সেই কাজটাই মনে হচ্ছিল অসম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ ম্যাচে ফিরেছে। বড় ব্যবধানের জয় নিশ্চিত করেছে সুপার ফোরের অংশগ্রহণ।
ক্যান্ডি থেকে লাহোর—দূরত্ব প্রায় ২ হাজার ৭৭০ কিলোমিটার। ক্যান্ডির পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অমন হারের পর লাহোরে বাংলাদেশ গিয়েছিল অমন বিশাল চাপ সঙ্গী করেই। সুপার ফোরে যাওয়ার লড়াইয়ে টিকে থাকতে গেলে জয়ের বিকল্প ছিল না। তার ওপর শ্রীলঙ্কার কাছে বড় হারে বেশ পিছিয়ে পড়েছিল নেট রানরেটেও। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচে চোট ছাড়াই একাদশে তিন পরিবর্তন বলছিল—বাংলাদেশ কতটা কোণঠাসা।
কিন্তু ব্যাটিং অর্ডারে চমক জাগানিয়া পরিবর্তন, একাদশে মাত্র পাঁচজন স্বীকৃত বোলার নিয়েই দাপটটা দেখাল সাকিব আল হাসানের দল। ৮৯ রানের বড় জয়ের সঙ্গে নেট রানরেটেও বাংলাদেশ দিয়েছে বড় এক লাফ। কার্যত তাই সুপার ফোরে উঠে গেছে বাংলাদেশ। ৫ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের ফলের ব্যবধান যাই হোক, দুই দলের রানরেটই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশের এমন দাপুটে জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছেন দুই সেঞ্চুরিয়ান মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাজমুল হোসেন। পাল্লেকেলেতে উইকেটের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাটিংটা এক নাজমুল ছাড়া কেউই করতে পারেননি বাংলাদেশের, লাহোরের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে ঘটেছে সেটির বিপরীত। টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়ার পর ওপেনারদের ভালো শুরু, টপ অর্ডারের পর মিডল অর্ডারের একজনের সেঞ্চুরি—বড় স্কোরের রেসিপি মেনেই এগিয়েছে বাংলাদেশের ইনিংস। সেটি আবার ঘটেছে একাধিক ব্যাটসম্যানের নিয়মিত পজিশন অদলবদলের পর!
পাঁচ বছর আগে মিরাজ ক্যারিয়ারে সর্বশেষ ওপেন করেছিলেন এশিয়া কাপেই, তা–ও আবার ফাইনালে। তখন সেটি ছিল ‘সারপ্রাইজ কল’, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অলরাউন্ডার মিরাজের উত্থানও তখন হয়নি। সেই মিরাজই ভালো একটা শুরু এনে দিলেন মোহাম্মদ নাঈমের সঙ্গে।
কিন্তু মুজিব উর রেহমানের দারুণ ডেলিভারিতে নাঈম ও তিনে আসা তাওহিদ গুলবদিন নাইবের ডেলিভারিতে ৪ বলের মধ্যে ফেরার পর চাপ তৈরি হয় বাংলাদেশের ওপর। ব্যাটিং ধস যে চোখ রাঙাচ্ছে তখন। সেটি হতে দেননি মিরাজ ও চারে আসা নাজমুল—যিনি সাম্প্রতিক সময়ে তিনেই খেলছিলেন। দ্রুত ২ উইকেটের চাপ সামাল দেওয়া, ইনিংস পুনর্গঠনের পর পাল্টা আক্রমণে বাংলাদেশের বড় স্কোরের শক্ত ভিতটা গড়েন দুজন। প্রথম ১৪ বলে মাত্র ৫ রান করা মিরাজ ফিফটিতে যান ৬৫ বলে।
নাজমুল অবশ্য শুরু থেকেই দারুণ ইতিবাচক ছিলেন। করিম জানাতকে মিড অনের ওপর দিয়ে তুলে মারা চার দিয়ে শুরু করা নাজমুল সুযোগ পেলেই খেলেছেন শট। তাঁর ফিফটি করতে লাগে ৫৭ বল।
ফিফটির পর গতি বাড়ান দুজনই। দ্বিতীয় পাওয়ারপ্লের প্রায় পুরোটাই খেলেছেন তাঁরা। প্রায় ৩২ ওভার ব্যাটিং করে ১৯৪ রানের জুটি দুজনের। লাহোরের তীব্র গরমের প্রভাব তাঁদের শরীরে পড়লেও ব্যাটিংয়ে পড়েনি। মিরাজ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটি পান গুলবদিন নাইবের বলে সিঙ্গেল নিয়ে, ১১৫ বলে। গত ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে আটে নেমে স্মরণীয় সেঞ্চুরির পর এবার ওপেনিংয়ে তিন অঙ্কের দেখা—মিরাজ তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্যে ছাপ রাখলেন আরেকবার। অবশ্য সেঞ্চুরির পর বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি, মুজিকে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে ছক্কা মারার পরই বাঁ হাতে টান লাগায় উঠে যান।
মাংসপেশিতে টান পড়ে নাজমুলেরও। এই বাঁহাতি অবশ্য রানআউট হয়েই ফেরেন। তবে তার আগেই পান ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। আগের ম্যাচে ৮৯ রানের পর আজ ১০৫ বলে ১০৪ রান, ভিন্ন দুই উইকেটে ভিন্ন ধরনের ব্যাটিং করে সফল নাজমুল। এ নিয়ে ওয়ানডেতে পঞ্চমবার এক ইনিংসে বাংলাদেশের দুজন সেঞ্চুরি পেলেন।
শেষ দিকে রানআউটেই টানা তিনটি উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান ও অভিষিক্ত শামীম হোসেনের ক্যামিও এনে দিয়েছে এশিয়া কাপে সর্বোচ্চ ও সব মিলিয়ে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ মানেই রশিদ খান ও মুজিব থাকেন বাড়তি আলোচনায়, তবে তাঁদেরকে দারুণভাবে খেলেছে বাংলাদেশ। দুজন ২০ ওভারে দিয়েছেন ১২৮ রান, ১ উইকেটের বিনিময়ে।
আফগানিস্তান এর আগে কখনোই ওয়ানডের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩০০ রানের স্কোর গড়েনি, এত রান তাড়া করে জেতা তো দূরের কথা। তবে এমন উইকেটে একটা আশা তো থাকেই। অবশ্য দ্বিতীয় ওভারেই শরীফুল ইসলামের বলে বিপজ্জনক রহমানউল্লাহ গুরবাজ ফেরায় কাজটি আরও কঠিন হয়ে পড়ে আফগানিস্তানের। ইব্রাহিম জাদরানের ১০০–এর বেশি স্ট্রাইক রেটের ৭৫ রানের ইনিংস, পরে হাশমতউল্লাহ শহীদির ইনিংসে লড়াইয়ের আভাস দিয়েছিল আফগানিস্তান।
কিন্তু মাঝে তিনটি জুটি ফিফটি পেরোলেও প্রত্যাশিত বড় হয়নি, সেঞ্চুরি বা কাছাকাছি বড় ইনিংসও ছিল না। উল্টো রানরেটের চাপ ছিল বড় বাধা। তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, শরীফুল ইসলাম, মিরাজরা এনে দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রু। রশিদ খান শেষ দিকে ক্যামিও খেলেছেন, তবে সেটি ব্যবধানই কমাতে পেরেছে শুধু।
বোলিংয়ের পর ব্যাটিংয়েও রশিদ কার্যকর কিছু করতে পারেননি, বাংলাদেশের দাপটের আরেকটি দিক তো হতে পারে সেটিও।