বিশেষ প্রতিনিধি,
সিলেট: চোরাচালানে জড়িত সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে সর্বোচ্চ দামে চোরাই চিনি তথা ‘বুঙ্গার চিনি’ নিলামে কিনে আলোচনায় আসেন সিলেটের তিন দরদাতা।
তারা নতুন সিন্ডিকেট গড়ে সর্বোচ্চ দরে চোরাই চিনি নিলামে কিনে নেন। শুল্কফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে চোরাই পথে আসা চিনির চালানকে ‘বুঙ্গার চিনি’ বলে।
বাজার দরের চেয়ে ৩০/৪০ টাকা বেশি দিয়ে চিনির চালান কেনার পর তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সিন্ডিকেট ভাঙতেই তারা বেশি দরে চিনি কিনেছেন। যে কারণে ক্ষতির বিষয়টিও তোয়াক্কা করেননি।
কিন্তু সপ্তাহ ঘোরার আগেই নতুন সিন্ডিকেটের একজন নিলাম বাতিল ও জামানতের টাকা ফেরত পেতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। আরেক নিলামগ্রহীতা আদালতের কাছে বাড়তি সময় চেয়েছেন।
গত ৩ জুলাই সিলেটের আদালতে তিন থানায় জব্দকৃত চিনির পৃথক তিনটি চালান নিলামে ওঠে। ওইদিন চিনির নিলাম ঘিরে আদালত প্রাঙ্গণ ছিল সরগরম। নিলামে অংশ নেন ৭০ জন। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন ছিলেন।
এরমধ্যে আলোচিত জালালাবাদ থানা পুলিশের জব্দকৃত ১৪ ট্রাক ভর্তি এক লাখ ৫ হাজার ৭০০ কেজি চিনি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে নিলামে নেন কালিঘাটের চাল ব্যবসায়ী ও দক্ষিণ সুরমার লতিবপুরের মৃত উস্তার আলীর ছেলে গিয়াস উদ্দিন। নিলামে কেনা তার চিনির কেজি সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটসহ দাম পড়ে ১৩২ টাকা পঞ্চাশ পয়সা।
একই দিনে এয়ারপোর্ট থানার জব্দকৃত ৬ টন চিনি ১৪২ টাকা কেজি দরে নিলামে কিনে নেন ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ওলিউর রহমান চৌধুরী বকুলের বড় ভাই ছৈদেরগাওয়ের বাসিন্দা আশরাফুর রহমান চৌধুরী।
এছাড়া দক্ষিণ সুরমা থানার ৯৪/’২৪ মামলায় জব্দকৃত ২ টন চিনি কিনে নেন ভ্যাটসহ ১২৮ টাকা কেজি দরে কিনে নেন যুবলীগ নেতা ফয়ছল আজাদ খান। তিনি নগরীর ৭/২ ফরিদবাগ হাউজিং এস্টেট এলাকার আবুল কালাম আজাদ খানের ছেলে।
ওইদিন কালিঘাটে প্রতিকেজি চিনির পাইকারি মূল্য ছিল ১০২ টাকা ২০ পয়সা। বাজার মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দরে চিনির নিলামে নেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে গ্রহীতারা জানিয়েছিলেন, চোরাচালানের সিন্ডিকেট ভাঙতেই তারা বেশি দরে চিনি কিনেছেন। তাতে ক্ষতির বিষয়টি তারা গুরুত্ব দেননি।
অথচ সোমবার (০৮ জুলাই) নিলাম বাতিল ও জামানতের টাকা ফেরত চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যে চিনি নিলামে নেওয়া গিয়াস মিয়া।
কোটিপতি গিয়াস মিয়া সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৩য় আদালতে দেওয়া দরখাস্তে নিজেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও গরিব লোক দাবি করে নিলাম বাতিলপূর্বক জামানতের ১০ লাখ টাকা ফেরত চেয়েছেন।
আদালতে দেওয়া আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, গত ৩ জুলাই আদালতে নিলামে ১২৫ টাকায় তিনি সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হন। ৫ কেজি চিনি শুকনা এবং ভালো দেখেই নিলামে অংশ নেন। পরে সরেজমিন জালালাবাদ থানায় গিয়ে দেখতে পান বেশিরভাগ চিনির বস্তা বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। যে কারণে ওই চিনি কিনে লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং বেশ কয়েক লাখ টাকা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নিজেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দাবি করে মানবিক কারণ দেখিয়ে গত ৩ জুলাই তার নামে ইস্যুকৃত নিলাম আদেশ বাতিলপূর্বক জামানতের ১০ লাখ টাকা ফেরত চান তিনি।
নিলাম বাতিলের বিষয় সম্পর্কে কালিঘাটের ব্যবসায়ী গিয়াস মিয়ার কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে, তার শরীর খাপার বলে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
একই আদালতে আরেকটি দরখাস্ত দেন এয়ারপোর্ট থানার জব্দকৃত ৬ টন চিনি নিলামে নেওয়া আশরাফুর রহমান চৌধুরী।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকা বন্যাকবলিত। তাই চিনির চালান হস্তান্তরের জন্য আরো ১৫ দিন সময় বর্ধিত চেয়ে আদালতে আবেদন করেছি। ’
তিনি জানান, গত ৪ জুলাই আদালত কর্তৃক নিলামগ্রহীতা হিসেবে তার নামে ইস্যুকৃত চিঠি সোমবার (৮ জুলাই) হাতে পাওয়ার পরই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। তবে নিলামগ্রহীতা হিসেবে জামানতের ২ লাখ টাকা ফেরত চাননি তিনি।
দক্ষিণ সুরমা থানায় জব্দকৃত চিনির চালান নিলামগ্রহীতা ফয়সল আজাদ খানও একই হাঁটছেন বলে জানা গেছে। তবে এ ব্যাপারে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের কালিঘাট পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি চিনির মূল্য পড়ে ১০২ থেকে ১০৫ টাকা। আর খুচরাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়। কিন্তু বাজার দরের চেয়ে অধিক দর দিয়ে নিলামে চিনি নেওয়ার নিয়ে তোলপাড় চলে।
নেপথ্যে রহস্য উদ্ঘাটনে অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্তে জানা গেছে, বিগত দিনে আদালত থেকে নিলামে নেওয়া চিনির চালানের কাগজ ব্যবহার করা হতো চোরাচালানে। সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে চোরাই পথে আনা চিনির চালান ধরা পড়লে নিলামের কাগজ তুলে ধরা হতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে। অনেকটা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতো এই নিলামের কাগজ। যে কারণে চোরাকারবারিদের কাছে চিনির চেয়ে কাগজের গুরুত্ব বেশি। তাছাড়া সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিলামে বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কিনে নেন গিয়াস মিয়া। কিন্তু তাকে সামনে রেখে তৈরি সিন্ডিকেট সদস্যরা নানা অজুহাত দেখিয়ে নিলামে বিনিয়োগ করেননি।
একাধিক সূত্র জানায়, গত ৬ জুন জালালাবাদ পুলিশ ১৪ ট্রাক ভর্তি চিনির চালান জব্দ করে। বিশাল এই চালানটি গত ৩ জুলাই সিলেটের আদালতে চড়া দামে নিলামে বিক্রি হয়। সে সময় চিনি নিলামের কাগজ চোরাচালানে ব্যবহারের ঘটনাটি আলোচনায় আসে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়, চোরাই চিনির ক্ষেত্রে নিলামের কাগজ প্রদর্শন করলে আটকানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই চোরাই চিনিতে বিনিয়োগকারীরা বিপাকে পড়েছেন।