দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ
বৃষ্টি থামছেই না। ঘরে ঘরে বন্যার পানি। পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। উপজেলার সুরমা নদীর তীরবর্তী কোনো কোনো স্থানে রাতে সামান্য পানি কমলেও বুধবার দিনব্যাপী অব্যাহত বৃষ্টিতে আবার তা বাড়তে শুরু করে। এতে দোয়ারাবাজার উপজেলার ৯ ইউনিয়নের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যোগাযোগের প্রধান সড়কগুলোসহ খোদ উপজেলা সদরে এখনও হাঁটু সমান পানি। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এবং দোকানঘরে পানি উঠতে শুরু করেছে।
বুধবার বানভাসি মানুষের কাছে ছুটে আসেন ছাতক-দোয়ারাবাজার আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিক। দিনব্যাপী তিনি উপজেলা সদর ও সুরমা ইউনিয়নের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং বন্যার্তদের মাঝে রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণসহ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। এসময় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেওয়ান তানভীর আল আশরাফী চৌধুরী, ইউ এন ও নেহের নিগার তনু ওসি মোঃ বদরুল হাসানসহ দলীয় নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় মুহিবুর রহমান মানিক এমপি বলেন, টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছেন। বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রশাসনসহ জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ত্রাণসমাগ্রীসহ বন্যার্তদের মাঝে রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন। উপজেলার সর্বস্তরের বন্যা কবলিত মানুষকে আশ্রয়ণ নিরাপত্তা, খাবার, ত্রাণসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঘরে ঘরে বানের পানি ঢুকে পড়ায় উপজেলায় ২৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে বানভাসি মানুষের ঢল নেমেছে। উপজেলার সদর, সুরমা, বোগলা, লক্ষ্মীপুর, বাংলাবাজার, নরসিংপুর, দোহালিয়া, মান্নারগাঁও, পান্ডারগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি ঢলের তোড়ে অন্তত দুই শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে বন্যার পানি অল্প কিছুটা কমলেও উপজেলা সদরসহ বেশির ভাগ এলাকাই বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। অনেক রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িতে এখনো কোমরসমান বন্যার পানি আছে। নিম্নাঞ্চলের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বন্যার্ত মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছে। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় মানুষ চরম দুর্ভোগে রয়েছে। বুধবার সকালেও মানুষের ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি দেখা যায়।
মঙ্গলবার সকালেই বসত ঘরে কোমরসমান পানি উঠেছিল। এমন পরিস্থিতিতে চোখে–মুখে আতঙ্ক নিয়ে ওইদিন উপজেলার সদর ইউনিয়নের লামাসানিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের পুত্র জাকির হোসেন স্ত্রী ও সন্তানাদি এবং গবাদি পশু নিয়ে উঠেছেন অন্যের বাড়িতে। তিনি বলেন, বানের পানিতে আমার পুকুরসহ ওই এলাকার সকল পুকুরের মাছ ইতোমধ্যে ভেসে গেছে। বন্যা কবলিত হয়ে পড়ায় খাদ্য সংকটে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে এখানকার মানুষ। ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় ওই গ্রামের অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন লামাসানিয়া দাখিল মাদরাসায়।
উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের শাহ জামাল জানিয়েছেন, গত তিনদিন ধরে সুরমা নদীর তীরবর্তী গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। ঘরে ঘরে এখন বানের পানি। বন্যায় কাবু হয়ে পড়েছে হাওরপাড়ের মানুষ। খাদ্য সংকট এবং গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছন নূরপুর, সোনাপুর, ভুজনা, আলীপুর, বৈঠাখাই, টিলাগাঁও, কাউয়াঘর,শরীফপুর, গিরিশনগর, আজবপুরসহ সুরমা ইউনিয়নের প্রায় সবকটি গ্রামের মানুষ।
লক্ষ্মীপু ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আহসান হাবিব হাসান জানান, উপজেলার লক্ষ্মীপুর, নোয়াপাড়া, এরুয়াখাই, নোয়াগাঁও, রসরাই, বড়কাটা, নতুন বৈঠাখাই, চকবাজার, তিলোরাকান্দি, বক্তারপুর, ইসলামপুর, আকিলপুর, সুরিগাঁও, তেরাদল, রণভূমি, নোয়াপাড়া, ঝিরারগাঁও, ইদ্রিসপুর, চৌকিরঘাট, সুলতানপুর, হাছনবাহার গ্রাম। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। ডুবে আছে স্থানীয় সবকটি সড়ক। বসত ঘরে পানি ডুকে পড়েছে।
বোগলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ মিলন খান জানান, বোগলাবাজার ইউনিয়নের সোনাচড়া, রামনগর, তেরাকুড়ি, বালিছড়া, আন্দাইর গাঁও, ক্যাম্পেরঘাট, বোগলা, বাঘাহানা গ্রামের শত শত মানুষ এখন পানিবন্দি আছে। অনেকের বসত ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। একই ভাবে বাংলাবাজার ইউনিয়নের রাজারগাঁও, পালকাপন, বাঘমারা, চিলাইপাড়, বাঁশতলা, চৌধুরীপাড়া, কলাউড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামের মোঃ শফিক মিয়া ও শেখ মোঃ রাসেল মিয়া জানান, আমাদের গ্রামের ২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় ব্রিজ ভেসে গেলে স্থানীয়রা এখানে বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করেছিলেন। ঈদের পর দিন বানের পানিতে ভেসে গেছে বাঁশের সাঁকোটিও। এ ছাড়া দোয়ারাবাজার উপজেলার পান্ডারখাল বাঁধের নিকটবর্তী বেড়িবাঁধ ভাঙনে সুরমার দক্ষিণাঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
পান্ডারগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহিদ জানিয়েছেন, বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিশেষ করে নতুন নগর, মঙ্গলপুর পলিরচর, কৃষ্ণনগর, জলসী, সোনাপুর, রাধানগর, ইসলামনগরসহ হাওরপাড়ের গ্রামগুলোর বন্যা কবলিত মানুষজন এখন আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এখানকার দেখার হাওরের উত্তাল ঢেউ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
অপরদিকে মান্নারগাঁও ইউনিয়নের আজমপুর, কাটাখালি, জালালপুর, চন্ডিপুর, আমবাড়ি, ইদনপুর, নোয়াগাঁও, পুটিপশি, হাজারীগাঁও, মান্নারগাঁও, গনার গাঁও, জুগির গাঁও, ডুলপশি, রাজারগাঁও, লামাগাঁওসহ বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ এখন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সুরমা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর বসত ঘরে ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে।
রাজনপুর গ্রামের নূর হোসেন মো. আব্দুল্লাহ জানান, উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের পাহাড়পুর, আঙগাঙ, রাজনপুর, কাঞ্চনপুর, চিত্তে রাজনপুর, ধর্মপুর, নলুরা, গোরেশপুর, বাদে গোরেশপুর, ধোপাখাই, কান্দাগাঁও, করালি, আলমপুর, হাজীনগর, দেওয়ান নগর, জঙলশ্রী, কুড়িল্লার পাড়, প্রতাপপুর, বেরিগাঁও নতুন ও পুরাতন, হরিপুর প্রায় সবকটি গ্রামের মানুষজনই এখন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ওই এলাকায় পাঁচটি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে।
দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ বলেছেন, বন্যার পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। আমার ইউনিয়নের বড়বন্দ, টেবলাই, মাইজখলা বাঘরা, সুন্দরপই, রাখালকান্দি, পরমেশ্বরী পুর, লামাসানিয়া, মুরাদপুর মাঝেরগাঁও , মাছিমপুর, নৈনগাঁও, এবং দোয়ারা বাজার সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ পাড়ে একমাত্র গ্রাম বাজিত পুর সহ সবকটি গ্রামের মানুষ এখন পানিবন্দি। ওইসব এলাকার মৎস্য খামারের সবগুলো পুকুরের মাছ ইতোমধ্যে বানের পানিতে ভেসে গেছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে খামারিদের।
নরসিংপুর ইউপি চেয়ারম্যান নুর উদ্দিন আহমদ জানান, নরসিংপুর ইউনিয়নের মন্তাজনগর, নাছিমপুর, নছরনগর, দৌলতপুর, রহিমের পাড়া, সানিয়া, লাস্তবের গাঁও, হাবিবনগর, শারপিনপাড়া, নতুন সিরাজপুর, ঘিলাছড়া, বিরেন্দ্রনগর, খাইরগাঁও, পুরান সিরাজপুর, প্রতাবের গাঁও, সানিয়া, খালপাড়, নেতরছই, কালাপশি, রগারপাড়, খন্তারগাঁও, ফুলকার গাঁও, চাটুরপাড়, বালিউরা, লেদারকান্দি, উত্তর শ্রীপুর, চাইরগাঁও গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আম্বিয়া আহমদ জানান, উপজেলার বন্যার্তদের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ১০টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আরও বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার চেয়ারম্যান দেওয়ান আল তানভীর আশরাফি চৌধুরী বাবু জানিয়েছেন, আমি বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের পাশে রয়েছি। সরকারি সহযোগিতা ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বানভাসি মানুষকে শুকনো খাবার এবং আশ্রয়ণের ব্যবস্থা করছি। এবারও বন্যার ভয়াবহতা তীব্র হতে পারে তাই সকলকে সতর্ক থাকতে হবে এবং জান-মালের নিরাপত্তায় সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।