ইসলামী জীবন,
কোরবানি ইসলামের অন্যতম নিদর্শন। কোরবানি দাতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কোরবানি দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ
‘আল্লাহর কাছে তাদের (কোরবানির পশুর) মাংস এবং রক্ত পৌঁছায় না বরং পৌঁছায় তোমাদের (কোরবানি দাতার) তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন মুহসিনদেরকে।’ (সুরা হজ: আয়াত ৩৭)
পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দেয় কোরবানি। আর এটা অন্য এক ধরনের আনন্দ যা কোরবানির মাংসের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হতো না। তাই কোরবানি না করে তার পরিমাণ টাকা সাদকা করে দিলে কোরবানি আদায় হবে না। কোরবানি আদায় হওয়ার জন্য রয়েছে কিছু শর্ত।
কোরবানির শর্তসমূহ,
১. কোরবানির পশু
এমন পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হলো- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এ গুলোকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহিমাতুল আনআম’। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِ
‘আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ: আয়াত ৩৪)
হাদিসে পাকে এসেছে, হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
لا تذبحوا إلا مسنة، إلا أن تعسر عليكم، فتذبحوا جذعة من الضأن
‘তোমরা অবশ্যই এক বছরের বয়সের ছাগল কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কোরবানি করতে পার।’ (মুসলিম ১৯৩৬)
আর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো জন্তু কোরবানি করেননি ও কোরবানি করতেও বলেননি। তাই কোরবানি শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে।
ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, কোরবানির জন্য সর্বোত্তম জন্তু হল শিং ওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের দুম্বা কোরবানি করেছেন বলে বুখারি ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে।
২. পশুতে ভাগ
উট ও গরু-মহিষে সাত ভাগে কোরবানি দেওয়া যায়। হাদিসে পাকে এসেছে, হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন-
نحرنا بالحديبية مع النبي صلى الله عليه وسلم البدنة عن سبعة، والبقرة عن سبعة
‘আমরা হুদাইবিয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কোরবানি দিয়েছি।’ (ইবনে মাজাহ ৩১৩২)
৩. হৃষ্টপুষ্ট পশু কোরবানি দেওয়া
গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হল কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া। অধিক মাংস সম্পন্ন হওয়া। নিখুঁত হওয়া এবং দেখতে সুন্দর হওয়া।
৪. কোরবানির পশুর বয়স
ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দুই বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের।
৫. পশু দোষ-ত্রুটি মুক্ত হবে
কোরবানির জন্য পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। হাদিসে পাকে এসেছে, হজরত বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন-
أربع لا تجوز في الأضاحي،- وفي رواية: تجزىء – العوراء البين عورها، والمريضة البين مرضها، والعرجاء البين ضلعها، والكسيرة التي لا تنقى
‘চার ধরনের পশু। যা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে পরিপূর্ণ হবে না- অন্ধ; যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু; যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত; যার কোনো অঙ্গ ভেঙ্গে গেছে। নাসাঈর বর্ণনায় ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে।’ (তিরমিজি ১৫৪৬, নাসাঈ ৪৩৭১)
আবার পশুর এমন কতগুলো ত্রুটি আছে, যা থাকলে কোরবানি আদায় হয় কিন্তু মাকরুহ হবে। এ সব দোষত্রুটি যুক্ত পশু কোরবানি না করা ভাল। সে ত্রুটিগুলো হলো- শিং ভাঙ্গা, কান কাটা, লেজ কাটা, ওলান কাটা, লিঙ্গ কাটা ইত্যাদি।
৬. পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে
যে পশুটি কোরবানি করা হবে তার উপর কোরবানি দাতার পূর্ণ মালিকানা স্বত্ব থাকতে হবে। বন্ধকি পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না।