বিশেষ প্রতিনিধি,
হাওরে অসময়ে অধিক পানি একদিকে যেমন হাওরপাড়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বিরূপ প্রভাব ফেলে, অন্যদিকে স্থল ও জলজ প্রাণির পুরো খাদ্যচক্রে আঘাত করাসহ অকাল বন্যায় জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলে। তেমনি সময়মতো হাওরে পানি প্রবেশ না করায় কয়েক বছর ধরে হাওরে তৈরি হচ্ছে নানা সংকট। মূলত চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখের মধ্যে হাওরগুলোতে পানি আসলেও গত কয়েক বছর ধরেই সেই চিত্র বদলেছে হাওরে। কখনও কখনও জৈষ্ঠের মাঝামাঝি বা শেষেও হাওরে পানির দেখা মিলে না। এতে করে হাওরে ব্যাপকভাবে দেশীয় মাছের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হওয়া, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণির ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। সম্প্রতি বৃষ্টিতে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ধর্মপাশা উপজেলার হাওরগুলোসহ জেলার বিভিন্ন হাওরে আংশিকভাবে পানি প্রবেশ শুরু করেছে। গত ২৯ মে ধর্মপাশা উপজেলার ধানকুনিয়া হাওরের দুয়েক জায়গায় স্থানীয়রা ফসলরক্ষা বাঁধ কেটে দেওয়ায় নদীর পানি হাওরে প্রবেশ করতে শুরু করে।
এর আগে গত ৫ মে হাওরে অবাধ পানি প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, মাছ রক্ষা ও বংশবৃদ্ধির জন্য ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল ও সোনামড়ল হাওরে তিনটি জলকপাট (স্লুইচগেট) খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু নদীতে পানির প্রবাহ কম থাকায় এ উদ্যোগ তেমন কাজে আসেনি। গবেষণা বলছে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অনাবৃষ্টি ও খরাপ্রবণতা বাড়া, অস্থায়ীভাবে হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণসহ নানা কারণে সংকটের মুখে পড়ছে হাওরের বাস্তুতন্ত্র।
কয়েক বছর ধরে হাওরে দেরিতে পানি আসায় কৃষক শতভাগ বোরো ফসল ঘরে তুলতে পারলেও কমেছে মাছের উৎপাদন। মাছের প্রজনন মৌসুমে হাওরে পানি না থাকায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট বাড়ছে। বাজারে চাষের মাছে এখন সয়লাব। বৈশাখের পর হাওরের জলাধারে থাকা ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ অবাধে নিধন চললেও প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। বৈশাখে বোরো ফসল উত্তোলনের পর অন্যান্য বছর পেশাদার জেলের পাশাপাশি অপেশাদার জেলেরা হাওরে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। হাওরে দেরিতে পানি আসায় দীর্ঘ সময় ধরে জেলেরা বেকার অবস্থায় দিন যাপন করেন।
হাওরে পানিহীনতা যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। হাওরে পানি এলেই হাওরাঞ্চলে বিয়েসাদিসহ বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের ধুম লেগে যায়। তখনও নৌকা বা ট্রলারের হাওরবাসী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আত্মীয়র বাড়িতে স্বল্পমূল্যে যাতায়াতের সুযোগ পান। হাওরে পানি আসাকে কেন্দ্র করে নৌকা ও ট্রলার ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে তাদের জলযান তৈরি করে রেখেছেন। কিন্তু পানির অভাবে সেগুলো কোনো কাজে আসছে না। এ কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নৌকার মালিকেরা।
গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে হাওরে পানি দেরিতে প্রবেশ করায়, হাওরে থেকে দেরিতে পানি নামে। এ কারণে বোরো ধানের চারা বপনের সময় এলেও বীজতলা পানিতে তলিয়ে থাকে। এতে করে বীজতলা তৈরিতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় চারা রোপনেও বিলম্ব হয়। তখন জমি থেকে পানি সরাতে ফসলরক্ষা বাঁধ কেটে পানি নামাতে হয়।
সুনামগঞ্জসহ হাওরজেলাগুলোতে বোরো ফসলের নিরাপত্তায় প্রতি বছর অস্থায়ীয়ভাবে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য হাওর থেকে মাটি কাটা হয়। বর্ষায় সেই মাটি আবার হাওর ও নদীতে মিশে তৈরি করে নাব্যতা সংকট। কিছু মাটি জমিতে মিশে জমি ও হাওরের স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করে। দেখা দেয় অকাল বন্যা। ঘটে ফসলহানীর ঘটনা। ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় পুরো হাওরাঞ্চলে শতভাগ ফসলহানী ঘটেছিল।
ওই সময় একদিকে যেমন ধান—চালের অভাব, অন্যদিকে খড় সংগ্রহ করতে না পারায় দেখা দিয়েছিলে গো খাদ্যের সংকট। ফলে কৃষক গরু, ছাগলসহ গবাদিপশু বাধ্য হয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। অবশ্য গবাদিপশু বিক্রি করার প্রধান কারণ কৃষকের নিজের খাবার সংগ্রহ ও ঋণ পরিশোধ। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছিলো মাছের মড়ক। আবার হাওরের পানিতে খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে মরেছিল অনেক হাঁস ও পাখি।
ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের হাঁসের খামারী মাজহারুল ইসলাম বলেন, হাওরে পানি না থাকলে হাঁসের খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তখন ডিম উৎপাদন কমে যায়। দেরিতে হলেও পানি আসতে শুরু করেছে।
ধর্মপাশা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা উৎপল কুমার সরকার বলেন, হাওরে পানি না থাকায় হাঁস খামারীর সংখ্যা কমে যায়। ধর্মপাশা ও মধ্যনগরে দেড় শতাধিক হাঁসের খামারী ছিল। যা কমে শতেকে চলে এসেছে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান বলেন, মে থেকে জুন পর্যন্ত দেশীয় মাছের প্রজনন মৌসুম। এ সময় হাওরে পানি না থাকলে মাছের বংশবিস্তার মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এতে করে মাছের উৎপাদন কমে যায়। মা ও পোনা মাছ নিধন রোধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
সুনামগঞ্জ পাউবোর উপ—সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফসলরক্ষার স্বার্থে স্লুইচগেটগুলো আটকে দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে হাওরে পানি প্রবেশ শুরু করেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে হাওর তার পূর্ণ রূপ ফিরে পাবে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ফসলরক্ষা বাঁধের কারণে হাওরে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিনষ্ট হয়। বাঁধের মাটি হাওরে নদীতে পড়ে নাব্যতা তৈরি হয়। বাঁধ কখনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এ জন্য নদী খননের প্রতি জোর দিতে হবে। বাঁধের কাজ করার জন্য এখনই হাওরে মাটি পাওয়া যায় না। আগামী কয়েক বছরে এ সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করবে। এ নিয়ে পরিকল্পিত ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বাঁধের বিকল্প কিছু বের করতে হবে।
দীর্ঘদিন হাওরের বাস্তুতন্ত্র, প্রতিবেশ ও জনসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা মেঘালয় পাহাড়ের চেরাপুঞ্জির ভাটিতে অবস্থিত হাওরাঞ্চলের মূল পানির উৎস উজানের ঝিরি, ছড়া ও পাহাড়ি নদী এবং মৌসুমী বৃষ্টিপাত। কিন্তু বছর বছর অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অনাবৃষ্টি ও খরাপ্রবণতা বাড়ছে হাওর এলাকায়। এমনকি এককে সময় অতিবর্ষণ ও অকাল বর্ষণ হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে আবার তলিয়ে যাচ্ছে জীবন ও জনপদ। পানিহীনতার কারণে হাওর জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রে সংকট তৈরি হচ্ছে। জলাভূমির উদ্ভিদ, মাছ, শৈবাল ও জলচর পাখিদের খাদ্য ও বিচরণ অঞ্চলে সংকট তৈরি হচ্ছে। হাওরের খাদ্যশৃংখল ও বাস্তুতন্ত্রে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হচ্ছে।
পাভেল পার্থ আরও বলেন, হাওরাঞ্চলে পানিহীনতা স্থানীয় যোগাযোগ ও জীবনজীবিকায় প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘসময়ের পানিহীনতায় নল, ইকর, বুনো গোলাপ, মনকাঁটা, হিজল, বরুণ, করচ, মূর্তা, বিন্যাছুবা, ঢোলকলমী ও বনতুলসীর মতো হাওর জলাভূমির উদ্ভিদের বিকাশ ও বিস্তারে সমস্যা হচ্ছে। নতুন পানির অভাবে মাছসহ জলজ জীবদের পানির খোঁজে কোনো একটি বাস্তুতন্ত্র ত্যাগ করতে হতে পারে। অনাবৃষ্টি ও পানিহীনতার কারণে হাওরাঞ্চলে প্রাণবৈচিত্র্য ও জীবন জীবিকায় সামগ্রিক প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতির নিরূপণ করে জাতীয় ক্ষয়ক্ষতির দলিলে এসব উদাহরণসহ উল্লেখ করা জরুরি।