বিশেষ প্রতিনিধি,
সিলেটে গত ২৭ মে থেকে শুরু হওয়া বন্যায় কয়েকদিন ভোগান্তির পর পানি কমতে দেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাদের সে প্রত্যাশা বেশিক্ষণ টেকেনি। গত রোববার সারারাত মুষলধারে ও গতকাল সোমবার থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে আবার ডুবে গেছে সিলেট নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা।
টানা বৃষ্টিতে নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টিই এখন প্লাবিত। সুরমা নদীর বিভিন্ন এলাকা দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করছে বানের পানি। বিশেষ করে নগরীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত উপশহর এবারও প্লাবিত। ২০২২ সালের বন্যায়ও ডুবেছিল উপশহর এলাকা। এবারও একই আশঙ্কা করছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
এদিকে বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে পানি প্রবেশ এবং বন্যা বাড়ায় কাল বুধবার কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে ভোট গ্রহণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ এরই মধ্যে দুটি উপজেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া গতকাল জকিগঞ্জের ছোট মাতার গ্রাম, জিয়াপুর ও বাদেদেউরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রসহ দুই উপজেলার ১০ থেকে ১৫টি কেন্দ্রে পানি প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ অবস্থায় বন্যা পরিস্থিতির বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান। সমকালকে তিনি বলেন, যেসব কেন্দ্রে পানি প্রবেশ করেছে, সেগুলো স্থানান্তরের চিন্তা করা হচ্ছে। পানি আর না বাড়লে আশা করছি, ভোট গ্রহণ করা যাবে। তার পরও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি।
টানা বৃষ্টি ও ঢলের কারণে গত ২৭ মে সিলেটে হঠাৎ বন্যায় সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়। অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
এ অবস্থায় গত শনি ও রোববার কিছুটা পানি কমতে থাকায় আশাবাদী হয়ে উঠেছিল বানভাসি মানুষ। কিন্তু রোববার রাতের বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে আবার সুরমা-কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদনদীর পানি অস্বাভাবিক বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সিলেটে ২৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়েছে বলে জানিয়েছে। সিলেট ও কানাইঘাটে সুরমা এবং কুশিয়ারার অমলশীদ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব এলাকায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। বিশেষ করে সিলেট নগরীর উপশহর এলাকার অবস্থা খুবই খারাপ। সরেজমিন দেখা গেছে, উপশহরের প্রধান সড়কের বিভিন্ন অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
এ, বি, সি, ডি, ই ব্লকসহ কয়েকটি ব্লকের বাসিন্দারা এখন পানিবন্দি। বিভিন্ন সড়কে কোথাও হাঁটু সমান পানি, কোথাও বা তারও ওপরে। পানি প্রবেশ করায় ডি ব্লকের ১৪ নং রোডে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের অফিস বন্ধ করা হয়েছে। উপশহরের পাশেই যতরপুর, তেররতন ছাড়াও নগরীর মেন্দিবাগ, জামতলা, তালতলা, শেখঘাট, কলাপাড়া মজুমদার পাড়া, মেজর টিলা, ইসলামপুরসহ শতাধিক এলাকার মানুষও এখন পানিবন্দি।
পানি প্রবেশ করেছে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনের নিচতলায়ও। এ ছাড়া বৃষ্টিতে হাসপাতালের সামনে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া জানান, প্রধান ফটকে জলাবদ্ধতাসহ হাসপাতালের নিচতলায় পানি উঠেছে। এতে ২৬, ২৭ ও ৩১ নং ওয়ার্ডের রোগীদের সেবা ব্যাহত হচ্ছে। পানির কারণে তিনটি ক্লাস পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল শহরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মখলিছুর রহমান কামরান। তিনি জানান, বন্যায় নতুন করে ছয় হাজার পরিবার ভোগান্তিতে পড়েছে। সব মিলিয়ে এখন নগরীর ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি। বর্ষণের কারণে ২৮টি ওয়ার্ড প্লাবিত।
গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে বানভাসিদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চাল বিতরণ করেছেন সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি। সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
গোলাপগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রোববার রাতের বৃষ্টিতে উপজেলার পৌর সদরের ছিটা ফুলবাড়ী ও ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের অনেক এলাকা ডুবে গেছে।
সুনামগঞ্জে হাওরে পানি নেই, নদী টইটম্বুর
পাহাড়ি ঢলের কারণে সুনামগঞ্জের সব নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। তবে অনেক হাওরে নেই পানি। জেলার বৃহৎ তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওরে সাবমার্সিবল সড়ক দিয়ে রোববারও যানবাহন চলাচল করেছে। বৌলাই নদীর তাহিরপুর বাজারের উল্টো দিকে মাটির বস্তা ফেলে বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো হয়েছে। এতে মাটিয়ান হাওরেও পানি প্রবেশ করছে না।
তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জুনাব আলী জানান, সোমবার দুপুরে সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের শক্তিয়ারখলার ১০০ মিটার ডুবন্ত সড়ক অংশ দিয়ে পাহাড়ি ঢল ঢোকায় শনির হাওরের বীরনগর বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে। আশা করা যাচ্ছে, দুই দিনের মধ্যে শনির হাওরে বর্ষার রূপ দেখা যাবে।
ঢল আসতে বিলম্ব হওয়ায় হাওরে পানি ঢোকাতেও সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ১৩৭টি হাওরের মধ্যে বড় ৪৮টির বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ করেন তারা। এগুলোর ২৫টির বাঁধ কেটে রাখা হয়েছে। অন্যগুলোরও খুলে দেওয়া হয়েছে রেগুলেটর। শনি, মাটিয়ান, মহালিয়া ও গুরমার হাওরে পানি ঢোকা শুরু হয়েছে। দুই দিনের মধ্যে হাওরের প্রতিটি জনপদে নৌকা চলবে।