বিশেষ প্রতিনিধি
এবার গতবারের চেয়ে আরও ১২০ কোটি টাকার বেশি ধান উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তীব্র গরম আর কালবৈশাখীর বজ্রাঘাতের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সুনামগঞ্জের হাওরে চলছে ধান কাটার ধুম। শ্রমিক-হার্ভেস্টার সংকটের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এর মধ্যেই অর্ধেকের বেশি ধান কাটা শেষ করছেন কৃষকরা।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, হাওরে ১৫ এপ্রিল থেকে এক ফসলি বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত হাওরে আবাদ করা ধানের প্রায় ৬৫ শতাংশ কাটা হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে হাওরের ধান শতভাগ কাটা হয়ে যাবে।
তবে হাওর এলাকার বাইরে আবাদ করা ধান কাটা শেষ করতে আরও ২০-২৫ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছর বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। এখনও প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় ধান সহজে কেটে, শুকিয়ে গোলাজাত করতে পারছেন কৃষক। এবার গতবারের চেয়ে আরও ১২০ কোটি টাকার বেশি ধান উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বোরো ধানের আশানুরূপ ফলনে তীব্র দাবদাহের মধ্যেও সোনার ফসল গোলায় তুলতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন হাওরের কৃষক-শ্রমিক পরিবারের নারী-পুরুষ-শিশু সবাই।
প্রতিটি হাওরে, খলায়, জাঙ্গালে সর্বত্রই তাদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। শুধু ধান কাটা ও মাড়াই নয়, খাওয়া-ধাওয়া-নাওয়া সবই চলছে হাওরে। কেউ সময় নষ্ট করতে চান না। কারণ যে কোনো সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসতে পারে।
দেখার হাওরের শিয়ালমারা এলাকায় দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে ক্ষেতে নেমেছেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের আলমচাঁন বিবি (৩৮)।
স্বামী শহরের একটি রড-সিমেন্টের দোকানে কাজ করায় আলমচাঁন বিবিই তীব্র গরমের মধ্যে তিন সন্তানকে নিয়ে ক্লান্তিহীন কাজ করছেন। ধান কাটার পর গবাদি পশুকে খাওয়ানোর জন্য তার সঙ্গে খড় কাটছে ছেলে ও মেয়ে।
আলমচাঁন বিবি বলেন, “আমার ১৫ বছর হয় বিয়ে হয়েছে। বিয়ের আগেই বাবার বাড়িতেও মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে এই সময়ে হাওরে কাজ করেছি। স্বামীর বাড়ি এসেও একই কাজ করছি।
“এই একটা মাস কষ্ট করতে হয় হাওরের কৃষক ঘরের নারী-শিশুসহ সবাইকেই। আমিও কাজ করছি।”
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে একজন কৃষক ও কৃষাণি ধান মাড়াইয়ের পর তার উপরের খড় পরিষ্কার করছেন।
প্রায় সাত কেয়ার (এক কেয়ারে ৩০ শতাংশ) জমিতে ধান আবাদ করেছে তার পরিবার। ফলনও মোটামুটি হয়েছে ভালো জানিয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যে অর্ধেক ফসল কেটে ফেলছি। এখন আর টেনশন নাই। কারণ ধান আর বন্যায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নাই।”
একই গ্রামের রিয়াজ উদ্দিনকে দেখা গেল স্ত্রীকে নিয়ে সড়কে খড় শুকাচ্ছেন। তিনি চার কেয়ার জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন, ২ কেয়ার কেটে ফেলছেন।
এখন হাওরের কৃষকদের অন্য কাজ করার কোনো সময় ও সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “পরতি বছর নতুন বৈশাখী ফসল তোলবার লাগি আমরা ঘরো থাকতাম পারি না। সবাইরে নিয়ে আওরে (হাওরে) নামতে অয়। ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যা ও শিলায় ফসলের ক্ষতির আশঙ্কায় সবাই ছুটে আসে আওরে।”
সঙ্গে তার চার সন্তানও হাওরে কাজ করছেন বলে জানান তিনি। শ্রমিকদের সঙ্গে তারা ধান শুকানো, চিটা ছড়ানো, খড় শুকানোসহ বাড়িতে ধান নিয়ে আসার কাজ করছে।
একই গ্রামের মালেহা খাতুনকে (৫০) দেখা গেল খলায় ভেজা ধান রোদে নাড়ছেন।
তিনি জানালেন তার কোনো ক্ষেত নেই। স্বামী মারা গেছেন। বড় ছেলেটা বিয়ে করে আলাদা হওয়ায় ছোট ছেলের কাছে থাকেন তিনি।
ছোট ছেলে একটি মাড়াই মেশিন কিনেছে। ছেলের সঙ্গে থেকে এই মেশিন তিনি পরিচালনা করেন। মাড়াই করে যে ধান পেয়েছেন সেটাই এখন শুকাচ্ছেন।
এ বছর ৫০-৬০ মণ ধান সংগ্রহ করতে পারবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “বৈশাখ আইরে বাচ্চা-কাচ্চা, বউ-ছউ সবরে নিয়ে আমরা আওরো নামি। আর কোনো পথ নাই আমরার।”
আরেক কৃষকের ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে নোমান হোসেন ক্ষেতে খড় কাটছে। নোমান বলে, “মা-বাবা একলা কাজ শেষ করতে পারে না। তাই আমরা দুই ভাই ও এক বোন ক্ষেতে কাজ করতে আইছি।
“আমরার নিজেরার কাজ নিজেই করতে অইবো। না কাটলে বইন্যায় লইয়া যাইবো। তখন খাইমু কিলা।”
জেলার প্রতিটি হাওরের চিত্র প্রায় একই। কৃষক পরিবারের পাশাপাশি শ্রমিকরাও তাদের সন্তানদের নিয়ে হাওরে কাজ করছেন। দম ফেলার ফুরসত নেই কারো। একমাত্র ফসল তোলার সংগ্রামে কেউ কারো দিকে তাকানোর সময়ও নেই।
বিশ্বম্ভরপুর গ্রামের খরচার হাওরের কৃষক স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, ২০-৩০ বছর আগেও ফরিদপুর, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, সাভার, গাজীপুর, রংপুর, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে ব্যাপারীরা (ধান কাটার শ্রমিক) আসতো।
“হাওরের সঙ্গে তারের মতো জড়িয়ে থাকা নদী হয়ে বড় বড় নৌকা নিয়ে তারা আসতেন। যাবার সময় ধান নিয়ে যেতেন। ভালো ফলন হলে তাদেরকে পোশাক-আশাক, খাসি এমনকি গরুও উপহার দিতেন কৃষক। তাদের আগমন ও বিদায়ে ঘরোয়া অনুষ্ঠানও হতো।”
কিন্তু এই চিত্র এখন দেখা যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “ওসব এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হওয়ায় এখন তারা আর আসে না। যে কারণে ধান কাটা বিলম্বিত হয়। প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢলে শেষ পর্যন্ত কিছু ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের মতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে।
এর মধ্যে হাওরে আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬১ হেক্টর জমি। বাকি ৫৮ হাজার ৪৬ হেক্টর জমি নন-হাওরে (অর্থাৎ পিডিবির ফসলরক্ষা বাঁধ এবং হাওরের জলাভূমির বাইরে)।
সোমবার পর্যন্ত হাওরের প্রায় ১ লাখ ২০০ হেক্টর বা ৬৪ ভাগ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। হাওর ও নন-হাওর মিলিয়ে গড়ে ৫০ ভাগ ধান কাটা শেষ।
কৃষি কর্মকর্তারা আরও জানান, হাওরে বোরো চাষ করেছেন ৩ লাখ ৭৮ হাজার পরিবার। কৃষক পরিবারের সন্তান, সন্ততিসহ সব মিলিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক রয়েছে।
পাশাপাশি ৭০ ভাগ ভর্তুকি মূল্যে পাওয়া আরও ৮৭০টি যন্ত্র (কম্বাইন হার্ভেস্টার) মাঠে আছে। একটি যন্ত্র ১০০ শ্রমিকের কাজ করে রোজ। এ ছাড়া ধান কাটার জন্য আরও ২০০টি রিপার যন্ত্র রয়েছে। একটি রিপার গড়ে রোজ ২০ জন শ্রমিকের কাজ করতে পারে।
তবে এর মধ্যে দুই শতাধিক যন্ত্র বিকল ও শতাধিক যন্ত্র বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে কৃষকদের অভিযোগ আছে।
তাছাড়া যন্ত্র সরবরাহ করা কোম্পানিগুলো মাঠে দুই বছর ওয়ারেন্টি দেওয়ার কথা থাকলেও কৃষকরা তা পাচ্ছেন না। ধান কাটার এই ভরা মৌসুমে কোম্পানির টেকনিশিয়ানদেরও খোঁজ না মেলায় ধান কাটা বিলম্বিত হচ্ছে বলে কৃষকদের অভিযোগ।
তবে সচল যন্ত্রগুলোর মাধ্যমে সহজে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাজাত করতে পারছেন তারা।
শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক পিসি দাস বলেন, “আমি এবার প্রায় শত কেয়ার জমিতে ধান করেছি। কিন্তু কাটানোর জন্য যন্ত্র পাচ্ছি না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই যন্ত্রগুলো অন্য জেলায় বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, “কাগজে যন্ত্র থাকলেও বাস্তবে মাঠে যন্ত্র নেই। সরকারের টাকা মিলে-মিশে লোপাট করা হচ্ছে। এখন ধান কাটার মৌসুমে আমরা যন্ত্র পাচ্ছি না।”
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, এবার প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় ধান কাটা, শুকানো ও মাড়াই করা যাচ্ছে সহজে। যন্ত্রে এবং যন্ত্রের বাইরেও দুই লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন।
তবে ৭৭টি যন্ত্র বিকল এবং কিছু যন্ত্র জেলার বাইরে নেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি।
এবার নন-হাওরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, বাকি জমি ২০-২৫ দিনের মধ্যে কাটা শেষ হয়ে যাবে। চলতি বছর বাম্পার ফলন হবে এবং গতবারের চেয়ে আরও প্রায় ১২০ কোটি টাকার বেশি ধান উৎপাদন হবে। যার সর্বমোট বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা।