বিশেষ প্রতিনিধি,
সিলেটের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে চার উপজেলার ৮০টি স্থান দিয়ে ভারত থেকে আসছে গরু-মহিষসহ নানা ধরনের পণ্য ও মাদক। এর মধ্যে আছে চিনি, পেঁয়াজ, চা পাতা, শাড়ি, জামা, প্রসাধনসামগ্রী, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন, জুতা, টায়ার, ওষুধ ও যানবাহনের পার্টস। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানিদের যেন উৎসব চলছে। ঈদ সামনে রেখে দিন-রাত পণ্য আনা হচ্ছে।
সরেজমিন বিভিন্ন স্পটে দেখা গেছে, গরু ও মহিষের চালান সীমান্ত পার করে এনে নির্দিষ্ট স্থানে মজুত করার পর সময় বুঝে ট্রাক কিংবা অন্য যানবাহনে পৌঁছে দেওয়া হয় গন্তব্যে। চিনি, পেঁয়াজ, মাদক, প্রসাধনসামগ্রী ও কাপড়ের বস্তা বা কার্টন শ্রমিকরা হাতে-পিঠে-মাথায় করে নিয়ে আসছেন। সীমান্ত পার করে নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো করার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি নেতাসহ জনপ্রতিনিধিরা।
তাদের মাধ্যমে পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, বিজিবির নাম করে টাকা নেওয়া হয়। অনেক পয়েন্টে আবার বাহিনীর সদস্যরা টাকা নেন। প্রতিদিন চোরাচালান পণ্য থেকে ৪০-৫০ লাখ টাকা আদায় করা হয়। এগুলো বিভিন্ন জনের পকেটে যায় বলে জানা গেছে।
গত মাসে জেলা পুলিশ বিভিন্ন স্থান থেকে ৮১ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ করে। এ ছাড়া ১২৫ বস্তা চিনিসহ তিনজনকে আটক করে। মহানগর পুলিশ নগর এলাকা অতিক্রম কিংবা প্রবেশকালে দুই কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য ছাড়াও এক হাজার বস্তা চিনি জব্দ এবং সাতজনকে আটক করে। বিজিবি অভিযান চালিয়ে চোরাচালান পণ্য জব্দ করেছে। তবে পুলিশ-বিজিবির অভিযানে জব্দ পণ্য মোট চোরাই পণ্যের এক হাজার ভাগের এক ভাগ হবে বলে অনেকে মনে করেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর সীমান্তে বেশি চোরাচালান হয়। এর পর আছে কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলা। এ ছাড়া জকিগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি এলাকা দিয়ে মাদক প্রবেশ করে। ৮০টি স্থান দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পণ্য আসে। অবৈধভাবে পণ্য আসার কারণে সরকার বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সেভাবে হয় চোরাচালান,
বেশির ভাগ চোরাচালান হয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারের শতাধিক ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন চোরাচালান। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকার আরও ১০০ জনের মতো ব্যবসায়ী রয়েছেন। জড়িত রয়েছে সিলেট নগরীর কিছু লোকও। পণ্যের বিপরীতে তারা হুন্ডিসহ বিভিন্নভাবে টাকা পরিশোধ করে থাকেন। এসব ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন চোরাচালানে।
ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ রয়েছে। সীমান্ত পার করায় নিয়োজিত থাকেন একশ্রেণির শ্রমিক। তারা পণ্য বহনের জন্য রাস্তার দূরত্ব বুঝে পারিশ্রমিক পান। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের কখনও ফাঁকি দিয়ে, কখনওবা ম্যানেজ করে পণ্য আনা হয়। যারাই যে মাধ্যমে পণ্য নিয়ে আসেন, টাকা দিতে হয়। ‘লাইনম্যান’খ্যাত লোকজন টাকা তোলে।
লাইন নিয়ন্ত্রণ করেন প্রভাবশালীরা। তাদের মধ্যে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। সীমান্ত পার করার পর পণ্য এলাকার বাড়ি কিংবা দোকানসহ নিরাপদ স্থানে মজুত করা হয়। পরে সেখান থেকে ট্রাক, পিকআপে হরিপুর বাজার কিংবা অন্য জায়গায় পাঠানো হয়।
গোয়াইনঘাট সীমান্ত,
সবচেয়ে বেশি সীমান্ত এলাকা গোয়াইনঘাট উপজেলায়। উপজেলার অন্তত ৩০টি স্থান দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে দেড়শ ট্রাক পণ্য আসে। আসে গরু-মহিষও। জাফলং জিরো পয়েন্টে গত ২৭ মার্চ দেখা গেছে, কয়েকজন তরুণ মাথায় চিনির বস্তা নিয়ে প্রবেশ করছেন। পাশেই সংগ্রামপুঞ্জি বিজিবি ক্যাম্প থাকলেও কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি সদস্যদের।
পণ্য বহন করে স্থানীয় বিভিন্ন গুদামে মজুত করে রাখা হয়। এ উপজেলার চোরাচালান পয়েন্টগুলোর মধ্যে আছে নলজুরি আমস্বপ্ন, তালতলা, তামাবিল স্থলবন্দর, সোনাটিলা, লালমাটি, জিরো পয়েন্ট, পুরাতন সংগ্রাম পুঞ্জি, নকশিয়া পুঞ্জি, নামাপুঞ্জি, পাদুয়া, সোনারহাট, বিছনাকান্দি ও দমদমা।
পুলিশের গরুর লাইন নিয়ন্ত্রণ করেন বিছনাকান্দি এলাকার কামাল মেম্বার, পশ্চিম জাফলংয়ের যুবলীগের দেলোয়ার হোসেন লুনি, রাধানগরের উজ্জ্বল, মানিক, জাফলংয়ের সুমন, মান্নান ও ফারুক মেম্বার, বিএনপি নেতা জয়নাল, জিয়াউল হক, যুবলীগ নেতা সোহেলসহ উপজেলা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা।
এ বিষয়ে জানতে আওয়ামী লীগ নেতা কামাল মেম্বারকে একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ করেননি। বিএনপি নেতা জিয়াউল হক নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে জানান, মাঝেমধ্যে সমতল এলাকা দিয়ে গরু ও মহিষ আসে। গোয়াইনঘাট থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, তাঁর এলাকায় চোরাচালান বন্ধ রয়েছে।
জৈন্তাপুর সীমান্ত,
জৈন্তাপুর সীমান্তের ৩০টি স্পট দিয়ে চোরাচালান হয়। সীমান্তের ওপারে বিভিন্ন বাড়িতে, জঙ্গলে, পাহাড় ও টিলার আড়ালে গরু-মহিষ বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকে। সন্ধ্যার পর উপজেলার নলজুরী, মোকামবাড়ী, আলুবাগান, শ্রীপুর, মোকামপুঞ্জি, মিলাটিলা, ছাগল খাউরী, কাঁঠালবাড়ী, আদর্শগ্রাম, কেন্দ্রী হাওর, ডিবির হাওর, ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী, টিপরাখলা, কমলাবাড়ী, করিমটিলা, গুয়াবাড়ী, বাইরাখেল, জালিয়াখলা, লালাখাল, জঙ্গীবিল, বালিদাঁড়া, বাঘছড়া, সিঙ্গারীপাড়, সুরাইঘাটসহ কয়েকটি এলাকা দিয়ে গরু-মহিষসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আসা হয়। গরুসহ কিছু পণ্য স্থানীয় হরিপুর বাজারে বিক্রি হয়।
পুলিশের নামে শফিকুল হক, বিজিবির নামে আবদুস সামাদ, আরমান, আবদুল জব্বার ও রুবেল টাকা উত্তোলন করেন। থানার ওসি তাজুল ইসলাম জানান, মূলত চোরাচালান রোধ বিজিবির কাজ। আমরা খবর পেলে অভিযান চালাই। প্রায় প্রতি সপ্তাহে পণ্য জব্দ ও লোক আটক করা হয়। পুলিশের নামে কেউ টাকা উত্তোলন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট সীমান্ত,
কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলার অন্তত ২০টি স্পট দিয়ে চোরাচালান হয়। কোম্পানীগঞ্জের উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের বরম সিদ্দিপুর, মাঝেরগাঁও, উৎমা, লামাগ্রাম ও তুরং এলাকা দিয়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১ হাজার বস্তা চিনি আসে। নতুন স্পট নারায়ণপুর, ছিকাডহর ও ছনবাড়ি দিয়েও পণ্য আসে। পাশের বিছনাকান্দি বাজার থেকে উত্তর রণিখাই হয়ে কোম্পানীগঞ্জ শহরেও আসে।
এসব পণ্য মজুত করা হয় ভোলাগঞ্জ, পারুয়া, শারপিন, বউবাজার, টুকেরবাজার ও খাগাইল বাজারে। গত ২২ মার্চ বরম সিদ্দিপুর সীমান্তে বিজিবির ওপর হামলা করে চোরাকারবারিরা। বরম সিদ্দিপুর সীমান্তে লাইনম্যান হিসেবে হেলাল আহমদ, তৈয়ব আলীসহ কয়েকজন চাঁদা আদায় করে।
কানাইঘাট উপজেলার ডোনা সীমান্ত ছাড়াও সোনারখেওড়, বড়গ্রাম, ভালুকমারা, ডেয়াটিলা, ডাউকেরগুল, বাখালছড়া, নারাইনপুরসহ কয়েকটি স্পট দিয়ে চোরাচালান হয়। এসব সীমান্তে চোরাকারবারে লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের শামসুল ইসলাম, আবুল কালাম, সাদ্দাম হোসেন, মারুফ, ইকবালসহ অন্তত ২০-৩০ জন জড়িত। কানাইঘাট থানার ওসি জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার জানান, তাঁর এলাকায় চোরাচালান হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে হলেও ধরা পড়ছে। গত মাসে পাঁচটি মামলা হয়েছে।
কোন পণ্যে কত টাকা দিতে হয়,
চোরাই পণ্য থেকে লাইনম্যানখ্যাত লোকজন পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও বিজিবির নামে চাঁদা আদায় করে। তারা পুলিশের নামে গরুপ্রতি এক থেকে তিন হাজার টাকা, বিজিবির নামে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা, প্রতিটি মহিষের জন্য তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা, প্রতি বস্তা চিনি কিংবা পেঁয়াজ থেকে পুলিশের নামে ১৫০ টাকা, বিজিবির নামে ১০০ টাকা আদায় করা হয়। একইভাবে কাপড়ের কিট বা কার্টনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার, মাদকের কার্টনে চার থেকে ছয় হাজার, মোটরসাইকেলে ১০-১২ হাজার, প্রসাধনসামগ্রীর কার্টন থেকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। ২০০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য ও শত শত গরু-মহিষের ওপর প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়ে থাকে। গত শুক্রবার রাতে জৈন্তাপুরের আলুরবাগান এলাকায় একটি মাদকের কার্টন পড়ে থাকতে যায়।
চোরাচালান নিয়ে যত হামলা-মামলা
গত ২২ জানুয়ারি কোম্পানীগঞ্জের বরম সিদ্দিপুর সীমান্ত এলাকায় বিজিবির ওপর হামলা করে চেরাকারবারিরা। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৩ মার্চ কানাইঘাটের সুরইঘাটে ভারতীয় চিনি আটকের জেরে করাতকলে চোরাকারবারিরা আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় করাতকলের মালিক তাজ উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। চোরাচালান নিয়ে এ থানায় এক মাসে পাঁচটি মামলা হয়েছে। ২৬ মার্চ জাফলংয়ে চোরাচালান লাইনের টাকা উত্তোলন নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়।
চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হেলাল আহমদ বলেন, বাজারের কেউ এতে জড়িত নয়। তাদের বাজার থেকে সীমান্ত অনেক দূরে। কে বা কারা চোরাচালান করে, তিনি জানেন না।
সহকারী পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. সম্রাট তালুকদার বলেন, সীমান্তে চোরাচালানের দায়িত্ব বিজিবির। পুলিশ অনেক সময় অভিযান চালিয়ে চোরাই পণ্য জব্দ করে। পুলিশ চোরাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে– এমন অভিযোগ কেউ করেনি। অভিযোগ এলে তদন্ত হয়।
বিজিবির সিলেট সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জিএইচএম সেলিম হাসান জানিয়েছেন, সীমান্ত রক্ষায় বিজিবি সব সময় তৎপর। প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকার চোরাই পণ্য জব্দ করার পর ধ্বংস করা হয়। বিজিবির নামে টাকা আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি তাদেরও কানে এসেছে। প্রমাণ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চোরাকারবারির গডফাদারদের আইনের আওতায় আনতে পারলে এটি রোধ সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।