Sunday, November 24, 2024
Homeইসলামযেভাবে জাকাতের হিসাব করবেন

যেভাবে জাকাতের হিসাব করবেন

ইসলামী জীবন:

ইসলামে সমাজের দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক প্রয়োজনের ব্যাপকতার প্রতি লক্ষ রেখে তৃতীয় হিজরিতে ধনীদের ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। সমাজে ধনসম্পদের আবর্তন ও বিস্তার সাধন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের মহান উদ্দেশ্যেই জাকাতব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকার সমস্যা সমাধানই জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

 

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত জাকাত বণ্টনের খাতগুলোর প্রতি লক্ষ করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল্লাহ বলেন, ‘সাদকা বা জাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, জাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্তাকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণ ভারাক্রান্ত ব্যক্তিদের, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও মুসাফিরদের জন্য; এটা আল্লাহর বিধান।’ (সুরা আত-তাওবা, আয়াত ৬০)।

 

 

ধনী লোকদের ধনসম্পদের ৪০ ভাগের এক অংশ অসহায় দরিদ্রদের মধ্যে জাকাত হিসাবে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ইসলামে। জাকাত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা না-থাকলেও রমজান মাসই জাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। রমজান মাসে যেকোনো ধরনের দান-সাদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি নেকি হাসিল হয়।

 

আমাদের যে সম্পদের ওপর জাকাত আসে তা সাধারণত পাঁচ প্রকার হয়ে থাকে। প্রথম প্রকার-স্বর্ণ। দ্বিতীয় প্রকার- রৌপ্য।

 

স্বর্ণ এবং রৌপ্য যেকোনো রূপে বা আকারে, যে কোনো উদ্দেশ্যে, আপনার মালিকানায় থাকুক, যেমন- অলংকার হিসেবে, বাণিজ্যিক আকারে কিংবা কারো কাছে আমানত বন্ধক রাখা স্বর্ণ। যেকোনোভাবে আপনার মালিকানায় থাকলেই এর ওপর জাকাত আসবে।

 

স্বর্ণে জাকাত ফরজ হবে যদি শুধু স্বর্ণ স্বতন্ত্রভাবে সাড়ে ৭ তোলা বা ৮৭.৪৫ গ্রাম বা এর বেশি থাকে।

 

রৌপ্যে জাকাত ফরজ হবে যদি শুধু রৌপ্য স্বতন্ত্রভাবে সাড়ে ৫২ তোলা বা ৬১২.৩৫ গ্রাম বা এর বেশি থাকে।

 

তখন স্বর্ণ ও রৌপ্যের সরাসরি চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অথবা মূল্যের ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে।

 

তৃতীয় প্রকার, টাকা। এটি কয়েকভাবে আমাদের কাছে থাকতে পারে।

 

ক) নগদ টাকা,

 

খ) কারো কাছে আমানত রাখা টাকা।

 

গ) ভবিষ্যতের কোনো উদ্দেশ্যে জমানো টাকা। যেমন হজ, বিয়ে-শাদী, ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে জমানো টাকা।

 

ঘ) ব্যাংকে জমানো টাকা বৈদেশিক মুদ্রা হলে তার মার্কেট মূল্য।

 

ঙ) বীমা-ইন্সুরেন্সে জমানো টাকা এবং প্রাইজবন্ড।

 

চ) কর্জ টাকা যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

 

ছ) যেকোনো ফেরত যোগ্য টাকা। যেমন: অ্যাডভান্স সিকিউরিটি, জামানত রাখা টাকা যার মূল্য বা বিকল্প আসবে।

 

জ) মুদারাবা সঞ্চয়ী ফান্ড অংশীদারিত্বের চুক্তিতে যে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় তার মূল পুঁজি এবং মুনাফাসহ হালাল টাকা।

 

ঝ) স্বর্ণ-রৌপ্য যদি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখিত পরিমাণের কম হয় তাহলে এর মূল্য নগদ টাকা হিসেবে ধর্তব্য।

 

ঞ) গাড়ি, বাড়ি, দোকান ইত্যাদির ভাড়া।

 

হারাম টাকায় জাকাত আসে না। হারাম টাকা সম্পূর্ণভাবে মূল মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া জরুরি।

 

চতুর্থ প্রকার, চতুষ্পদ জন্তু বা গবাদিপশু।

 

যদি স্বতন্ত্রভাবে ছাগল ৪০টি, গরু ৩০টি, উট ৫টি বা এর বেশি থাকে তাহলে সুনির্দিষ্ট হারে গবাদিপশুর জাকাত ফরজ হয়। গবাদি পশু এই সংখ্যায় না পৌঁছালে ব্যবসায়ীক সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে।

 

পঞ্চম প্রকার, ব্যবসায়িক সম্পদ।

 

ক) দোকানের মালামাল। বিক্রির উদ্দেশ্যে ক্রয় করা জমি, গাড়ি, গরু, ছাগল,উট (যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক না হয়) পাখি ইত্যাদি।

 

খ) কোম্পানির শেয়ার মূল্য।

 

উপরোক্ত সব খাতে আপনার মালিকানার সব সম্পদ যোগ করে যে টাকাটা হবে, সেই টাকা থেকে নিম্নের এসব বিয়োগ করতে হবে।

 

১) সকল প্রকার ভাড়া- বিল। যেমন: বাড়ি, দোকান, গুদাম, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ইন্টারনেট বিল।

২) কর্মচারীর বেতন। আপনার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হোক অথবা বাড়িঘরের হোক।

 

৩) বাকিতে ক্রয় কৃত পণ্যের মূল্য বা যে কোন প্রকার ঋণ।

৪) বিগত বছরের অনাদায়ী জাকাতের পরিমান।

 

মোট সম্পত্তি থেকে এই চার খাতের মোট টাকা বিয়োগ করে, দেখতে হবে আপনার মালিকানায় মোট কত টাকা অবশিষ্ট আছে?

 

এরপর জাকাত দেওয়ার আগে আপনার নেসাব চিহ্নিত করতে হবে।

 

জাকাতের নেসাব দুই প্রকার,

 

দরিদ্রবান্ধব নেসাব: দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য দুটি পরিমাণের তুলনামূলক কম পরিমাণ সম্পদকে জাকাতের নেসাব হিসেবে ধর্তব্য করে জাকাত প্রদানে এগিয়ে আসা।

 

স্বার্থ বান্ধব নেসাব: দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কম দেওয়ার অথবা একেবারে না দেয়ার উদ্দেশ্যে দুটি পরিমাণের তুলনামূলক বড় পরিমাণকে জাকাতের নেসাব হিসেবে ধর্তব্য করে, কম দেয়ার অথবা জাকাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করা।

 

দরিদ্রবান্ধব নেসাব হচ্ছে, সাড়ে ৫২ তোলা বা ৬১২.৩৫ গ্রাম রৌপ্য।

 

আর স্বার্থ বান্ধব নেসাব হচ্ছে, সাড়ে ৭ তোলা বা ৮৭.৪৫ গ্রাম স্বর্ণ।

 

শরিয়া আপনাকে স্বাধীনতা দিয়েছে দরিদ্রবান্ধব নেসাব অথবা স্বার্থ বান্ধব নেসাব এর যেকোন একটি বেছে নেওয়ার। আর কোন নেসাব বেছে নিলে আপনার আখেরাত উজ্জল হয় সেটা খুবই সুস্পষ্ট।

 

এবার দেখুন আপনার মোট সম্পদ উল্লেখিত দুটি নেসাবের কোন একটির পরিমাণ অথবা বেশি কিনা?

 

যদি

ক) কোন একটির পরিমাণ অথবা বেশি হয়,

 

খ) এই পরিমাণ সম্পদ আপনার জরুরি প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবে।

 

গ) এক বছর পর্যন্ত আপনার কাছে স্থায়ী হয়।

 

তাহলে এই অতিরিক্ত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ, বা শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা বা লাখে আড়াই হাজার টাকা।

 

কুরআনে বর্ণিত জাকাত বন্টনের সুনির্দিষ্ট আটটি খাতের কোন একটিতে অথবা সকলটিতে বন্টন করে দেওয়া আপনার ওপর ফরজ।

 

আল্লামা ইসহাক জালালাবাদী তার হাদিসের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা গ্রন্থ দরসে মিশকাতের ২য় খণ্ডের ১৮৫নং পৃষ্ঠায় জরুরি প্রয়োজনের সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

 

আপনার জরুরি প্রয়োজন নির্ভর করে আপনি কোন পেশার মানুষ।

 

এক. আপনি যদি কৃষক হয়ে থাকেন তাহলে, এক মওসুম থেকে আরেক মওসুম পর্যন্ত খানা-পিনা, নিত্য প্রয়োজন সেরে আবার ফসলের মাঠ প্রস্তুতের সামর্থ্য থাকা আপনার জরুরি প্রয়োজন। এর অতিরিক্তটা নেসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে।

 

দুই. আপনি যদি ব্যবসায়ী হন তাহলে আপনার প্রথমবার হাট করে অথবা দোকানে পণ্য তোলে, আরেকবার পণ্য তোলা পর্যন্ত আপনার খানাপিনা, নিত্য প্রয়োজন পরবর্তী পণ্য কেনা পর্যন্ত সামর্থ্য থাকা আপনার জরুরি প্রয়োজন। এর বাহিরে যা থাকবে তা নেসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে।

 

তিন. আপনি যদি চাকুরীজীবী হন তাহলে দেখতে হবে আপনি কতদিন পর পর বেতন পান। যদি বাৎসরিক হিসেবে বেতন পান তাহলে এক বৎসরের খানাপিনা ও নিত্যপ্রয়োজন সারার মত সম্পদ আপনার জরুরি প্রয়োজন। যদি মাসিক হিসেবে বেতন পান তাহলে এক মাসের খানাপিনা ও নিত্যপ্রয়োজন সারার মত সম্পদ আপনার জরুরি প্রয়োজন।

 

যদি সাপ্তাহিক বেতন পান তাহলে এক সপ্তাহের খানাপিনা ও নিত্যপ্রয়োজন সারার মত সম্পদ আপনার জরুরি প্রয়োজন। যদি দৈনিক বেতন পান তাহলে একদিনের খানাপিনা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সম্পদ আপনার জরুরি প্রয়োজন। এর অতিরিক্ত যে টাকা থাকবে তা নেসাবে অন্তর্ভুক্ত হবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments