বিশেষ প্রতিনিধি:::
দখলে-দূষণে বিপন্ন হওয়ার পথে রয়েছে এককালের খরস্রোতা নদী ‘বাসিয়া’। একদিকে মানুষের অত্যাচারে নদীটি বর্তমানে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, অন্যদিকে অবৈধ দখল ও স্থাপনা নির্মাণের ফলে প্রায় ২ শত মিটার (৬ শত ফুট) প্রস্থের ‘বাসিয়া নদী’ ড্রেইনে পরিণত হওয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রায় ৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘের বাসিয়া নদীর উৎসমুখ ও নিষ্পত্তি মুখ দুটি ভরাটে বিলীন ও দখলদারদের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ফলে বর্তমানে ‘লাইফ সার্পোটে’ রয়েছে বাসিয়া নদীটি।
ভূমিখেকো চক্রের অবৈধ দখল ও স্থাপনা নির্মাণ এবং ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ের ফলো যেনো ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গেছে বাসিয়া নদী। আর বিশ্বনাথ পৌর এলাকা’সহ বিভিন্ন এলাকায় ক্যান্সারে আক্রান্ত ‘বাসিয়া নদী’র বিষাক্ত দূর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। ওই বিষাক্ত দূর্গন্ধে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি ভরাট হওয়ে যাওয়া বাসিয়া নদীতে পানি সংকটের ফলে ব্যঘাত ঘটছে চাষাবাদে। ফলে চরম বিপাকে পড়ছেন কৃষকরা।
‘সুরমা নদী’ থেকে সিলেটের জালালাবাদ থানার মাসুকগঞ্জ বাজার নামক স্থান থেকে এক কালের খড়স্রোতা নদী ‘বাসিয়া’র উৎপত্তি, আর সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার রাণীগঞ্জের স্বাধীন বাজার নামক স্থানে ‘কুশিয়ারা নদী’র সাথে মিলিত হয়ে শেষ হয়েছে। যৌবনকালে বাসিয়া নদী ব্যবহার করেই চলাচল ছিল ‘জালালাবাদ-দক্ষিণ সুরমা-বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর-জগন্নাথপুর’র বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের। বাসিয়া নদীর পানি ব্যবহার করে ওই ৫ ‘থানা ও উপজেলা’র নদীর তীরবর্তি স্থানে কৃষকরা উৎপাদন করতেন ব্যাপক পরিমাণ ধান-সবজি। মৎস্যজীবিরা শিকার করতেন বিপুল পরিমাণ মাছ। যা পূরণ করতো এসব এলাকার মানুষের আমিষের চাহিদার বড় অংশ।
কিন্তু ২/৩ দশক ধরে ‘মাসুকগঞ্জ বাজারে বাসিয়া নদীর উৎসমুখ ও স্বাধীন বাজার নিষ্পত্তিমুখ’ দুটি বন্ধ করায় এবং বিশ্বনাথসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীর দুই তীর অবৈধভাবে দখল, ময়লা-আবর্জনা ফেলে ও অবৈধভাবে ভরাট করায় বাসিয়া নদী তার যৌবন হারিয়ে একটি মরা খাল তথা ড্রেনে পরিণত হয়েছে। তাই বর্ষা মৌসুমেও এটি যে একটি নদী তা বুঝার উপায় নেই, আর শুকনো মৌসুমেতো ছোট ছোট শিশুরা পায়ে হেঁটে সহযেই নদীর এপার থেকে ওপারে যেতে পারে। বাসিয়া নদীর এমন পরিণতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমাদের কৃষিখ্যাতের ও ধ্বংস হয়েছে আমিষের চাহিদা পূরণের অন্যতম ক্ষেত্র। অথচ এক সময় ওই বাসিয়া নদীর বুক দিয়ে চলাচল করতো বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার ও পালতোলা নৌকা।
পৌরসভা’সহ বিশ্বনাথ নতুন-পুরাণ বাজারের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের ফেলা ময়লা-আবর্জনায় ‘ময়লার ভাগাড়ে’ পরিণত করা পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ‘বাসিয়া নদী’র এপার থেকে ওপারে পায়ে হেঁটে যেতে জনসাধারণকে বিষাক্ত দূর্গন্ধের অতিষ্ঠ হতে হয়। প্রতিনিয়তই ওই দূর্গন্ধের সাথে মিতালী করে ব্যবসা পরিচালনা করতে হচ্ছে নদীর দুই তীরের শত শত ব্যবসায়ীকে। তাই স্কুলগামী শিক্ষার্থী, মসজিদগুলোতে আসা মুসল্লী, মন্দিরে আসা পূর্ণ্যাথী, ব্যবসায়ী’সহ সর্বসাধারণ বাসিয়া নদী থেকে আসা বিষাক্ত দূর্গন্ধে প্রতিনিয়তই আক্রান্ত হচ্ছেন নানান রোগব্যধিতে।
বিশ্বনাথ উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বনাথে বাসিয়া নদীর দুই তীরে গড়ে উঠা বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে আদালতে ১৮৭ জনের নামে মামলা চলমান রয়েছে (মামলা নং ০৪/২০১৭)। কিন্তু প্রায় ৭ বছর অতিবাহিত হলেও এখনও সেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। এই মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দখলকারীদের করা দুটি রিট আবেদন (রিট মামলা নং ৯১৩৫/২০১৭ ও ৫৩৪০/২০১৭) চলমান রয়েছে।
বিশ্বনাথ বাজারের আব্দুল গফুর, আবুল কালাম, মোশাহিদ আলী’সহ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য নির্ধারিত কোন স্থান না থাকায়, তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। পৌর মেয়র ময়লা ফেলার একটি ডাসবিন রেখেছেন, তবে সেটি বেশ ছোট হওয়ার কারণে সহযেই তা ভরে যায়। আর আমরা দেখেছি ওই ডাসবিনে ফেলা ময়লাগুলোও রাতের আধাঁরে নদীতেই ফেলেন পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। ফলে লাভ কি হল?
এব্যাপারে ‘বাঁচাও বাসিয়া নদী ঐক্য পরিষদের’ আহবায়ক ফজল খান জানান, বাসিয়া নদী রক্ষা করতে দীর্ঘদিন ধরে আমরা আন্দোলন করছি, কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। কারণ এখানে রক্ষকরা, ভক্ষক হয়ে গেছেন। আমরা বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়রকে নদী উদ্ধারের জন্য অবৈধ স্থাপনার তালিকাসহ প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র দিয়েছি। কিন্তু এখন কোনো কাজ হয়নি, এখনও সব কিছু পূর্বের মতোই চলছে। তাই বাসিয়া নদী উদ্ধারে এখন আমরা ‘প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি’র হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেলোয়ার হোসেন সুমন এব্যাপারে বলেন, বাসিয়া নদী এখন মহামারি অবস্থায় আছে। এ নদীর ময়লা-আজর্বনা থেকে মানুষের মধ্যে হাপানী-শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবানু ছড়াচ্ছে। এই ময়লা দূষিত পানি থেকে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ, ক্যাপিস, ফুটপাচড়া জাতীয় রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা ভবিষ্যতে এলাকাবাসী স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে বেশি।
বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান বলেন, আপাতত ময়লা-আবর্জনা ফেলতে স্থায়ীভাবে কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। তবে দ্রুত আমরা এর একটি ব্যবস্থা করব। আর স্থায়ী ব্যবস্থা করার পর থেকে নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেললে তাদেরকে জরিমানা দিতে হবে।
এব্যাপারে বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা আক্তার বলেন, বাসিয়ার নদীর দুই তীরে থাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দখলকারীদের দুটি রিট মামলা চলমান থাকায়, আপাদত উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তবে রিট মামলার রায়ের পর আদালতের সিদ্ধান্তনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি বলেন, সরকারের বড় একটি উদ্যোগ হচ্ছে দেশের নদীগুলো উদ্ধার করা ও নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা। বাসিয়া’সহ সকল নদী রক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে বাসিয়া নদীর তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেন ও পুনঃখনন করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকৌশলীর সাথে বৈঠকও হয়েছে।