Friday, November 8, 2024
Homeসারাদেশচিকিৎসক-নার্সরাও ডেঙ্গু আতঙ্কে

চিকিৎসক-নার্সরাও ডেঙ্গু আতঙ্কে

 

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। রেহাই পাচ্ছেন না কোনো বিশেষ শ্রেণি-পেশার কেউ। সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হলে যেসব চিকিৎসক ও নার্স চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন, এখন তারাও ঝুঁকিতে পড়েছেন। চিকিৎসক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জুন থেকে চিকিৎসক ও নার্সদের আক্রান্তের হার বাড়ছে।

 

এরই মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে দুই শতাধিক চিকিৎসক এবং দেড় শতাধিক নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে চারজন চিকিৎসক ও একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে চারজন নারী ও একজন পুরুষ চিকিৎসক ছিলেন। মৃতদের প্রত্যেকের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে ছিল। সবশেষ শুক্রবার ডা. শরীফা বিনতে আজিজের মৃত্যুতে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে সবার মাঝে।

 

চিকিৎসক সংগঠনের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের ২২ জুন ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান ডা. এম আরিফুর রহমান। তিনি বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৩৯তম ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন। ২২ জুলাই রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাভারের সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. ফাতেমা-তুজ-জোহরা রওনক। এর দুদিন পর ২৫ জুলাই রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ব্যাচের শিক্ষার্থী ও নবীন চিকিৎসক সৈয়দা সাদিয়া ইয়াসমিন (রাইসা) মারা যান। ৭ আগস্ট মারা যান বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের রেসিডেন্ট ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু। সবশেষ ১১ আগস্ট ঢাকা মেডিকেলে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান প্রতিষ্ঠানটির মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. শরীফা বিনতে আজিজ (আঁখি)।

 

বাংলাদেশ চিকিৎসক ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. নিরুপম দাস যুগান্তরকে বলেন, দেশের হাসপাতালগুলো ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে উঠছে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ জন চিকিৎসক ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের বেশি। বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক বেশি পরিমাণ আক্রান্ত হচ্ছেন। এটি আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতাল এখন ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে। এ কারণে চিকিৎসক ও রোগীর সুরক্ষায় হাসপাতালে এডিস মশা নিধন অভিযান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসকদের ডেডিকেটেড বিছানা রাখা জরুরি। এছাড়া আক্রান্ত ও মৃত্যুদের ঝুঁকি ভাতা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

 

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে ২ জনের ছিল এনসেফালাইটিস তথা এক্সপান্ডেন্ট ডেঙ্গু সিনড্রোম। রোগীর সিটি-স্ক্যান ছাড়া ডেঙ্গু এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত ধরা পড়ে না। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় শতাংশ এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এনসেফালাইটিস সরাসরি ব্রেনকে আক্রান্ত করে। জটিল ইনফেকশন তৈরি করে। প্রতি ১০০ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে ৩ থেকে ৪ জনের এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি ধরা পড়লে নিউরো মেডিসিন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা ও দ্রুত আইসিইউ সাপোর্ট নিতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, স্টেরয়েডের প্রয়োজন হয়। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করতে ব্যর্থ হলে রোগীর মস্তিষ্কে প্রদাহ তৈরি হয়ে ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া এক্সপান্ডেন্ট ডেঙ্গু সিনড্রোম রোগীদের হার্ট, নার্ভ সিস্টেম, অন্ড্রো, অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাল অ্যাটাক করে। এ ধরনের জটিলতায় রোগীর রেসিডিউয়াল সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফলে রোগী মারা যান।

 

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, মশা এখন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতেও প্রাদুর্ভাব রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীকে কামড়ানো মশা চিকিৎসক-নার্সদেরও কামড়াচ্ছে। তবে ডেঙ্গুতে কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হলে শারীরিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়। হয়তো মারা যাওয়া চিকিৎসকরা আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যেটি তারা বুঝতে পারেননি। ডেঙ্গু ভাইরাস রোগীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে। হার্ট, লান্স, কিডনি লিভার, ব্রেন, রক্ত কোনো অংশ বাদ যায় না। রক্তে আক্রান্ত হলে প্লাটিলেট কমে যায়। এনসেফালাইটিস বা ব্রেনে ইনফেকশন (প্রদাহ) ও রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেটি খুব জটিল ও কম সংখ্যকের মধ্যে দেখা যায়। দ্রুত চিকিৎসা না করলে রোগী মারা যায়।

 

তিনি বলেন, গর্ভবতী নারী, বয়স্ক, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার, স্ট্রোক, ক্যানসার আক্রান্তদের ইমিউনিটি কম থাকায় তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। ফলে রোগীদের সেবাদানের জন্য সরকারকে চিকিৎসক-নার্সদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সেবাদান ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা থাকবে।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভারের শুরুতেই একিউট প্রবলেম দেখা যায়। কোমরবিডিটি (দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ) সম্পন্নদের মধ্যে একটি গ্রুপের এক্সপান্ডেন্ট ডেঙ্গু সিনড্রোম হয়। তাদের জ্বর ছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ভাইরাল অ্যাটাকের ইতিহাস থাকে। যেটি এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এতে মৃত্যুহারও বেশি হয়।

 

নার্সিং ও মিডওয়াইফারী অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসন (উপসচিব) মো. নাছির উদ্দীন বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে ১৫০ নার্স ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। তবে কারও মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। অধিদপ্তর থেকে নার্সদের সুরক্ষায় ঢাকা বিভাগের অন্তত ৭০টি হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্টদের নিয়ে কর্মশালা করা হয়েছে। কীভাবে ডেঙ্গুতে সুরক্ষা থাকতে হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কেউ আক্রান্ত হলে তাদের ঝুঁকি ভাতা দেওয়া উচিত।

 

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক বলেন, ডেঙ্গু রোগীকে কোনো সুস্থ মশা কামড়ালে ওই মশাও শরীরে জীবাণু বহন করে। এরপর মশাটি কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে তারও ডেঙ্গু পজিটিভ হয়। এসব কারণে হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গুর হটস্পট মনে করা হচ্ছে। ফলে রোগী সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ডেঙ্গু সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments