বিশেষ প্রতিনিধি:
সিলেট নগরে সবজি ও ফলবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি হচ্ছে। চাঁদা না পেলে পরিবহনশ্রমিকদের মারধর করা হয়, টাকাপয়সা এমনকি পণ্য পর্যন্ত লুটে নেয় চাঁদাবাজেরা। গত চার মাসে এমন অন্তত পণ্যবাহী ১২টি যান চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি রাতে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ছয় থেকে আট লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সেই হিসাবে মাসে প্রায় দুই কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। শহরের তিনটি প্রবেশমুখে প্রকাশ্যেই এসব চলছে। অথচ পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। চাঁদাবাজেরা নিজেদের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন বলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন।
কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় শীতকালীন প্রচুর সবজি ও ফল উৎপাদিত হয়। এসব কৃষিপণ্য বিক্রির জন্য ট্রাক ও পিকআপ দিয়ে সিলেট শহরে নিয়ে আসা হয়।
পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলেছেন সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ‘জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ’ নোটিশের আলোচনায় এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকা সিলেটে কিছু সন্ত্রাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রাতে ট্রাক থামান তাঁরা,
গত ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত তামাবিল-সিলেট সড়কের বটেশ্বর, শাহপরান, মেজরটিলা ও টিলাগড় এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, পাঁচ থেকে ছয়জন তরুণ মোটরসাইকেল নিয়ে স্থানগুলোতে টহল দেওয়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কয়েকজনের মাথায় হেলমেট ছিল। ট্রাক বা পিকআপ এলে ওই তরুণেরা যানগুলো থামিয়ে চাঁদা আদায় করছেন। প্রথম দিন দুই ঘণ্টায় অন্তত ১৪টি ট্রাককে হাতের ইশারায় থামালেন তরুণেরা।
একইভাবে ১৭ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে ভোলাগঞ্জ-সিলেট সড়কের লাক্কাতুরা অংশে চার তরুণকে প্রাইভেটকার নিয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। রাত একটা পর্যন্ত তিনটি সবজির ট্রাক আটকে চাঁদা আদায় করতে দেখা গেল। একপর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে দ্রুত তাঁরা চলে যান।
ট্রাকচালক, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চাঁদাবাজেরা নিজেদের ছাত্রলীগের জেলা ও মহানগর পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের কর্মী-সমর্থক বলে পরিচয় দেন। গত চার মাসে সবজিবাহী অন্তত ১২টি যানবাহন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও ভুক্তভোগীরা ভয়ে এ বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগ করেননি। সর্বশেষ ১ ফেব্রুয়ারি তেমুখী এলাকায় একটি ফলের ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, চাঁদাবাজদের টাকা দেওয়ার প্রভাব সবজি ও ফলের দামেও পড়ছে। চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়ে ব্যবসায়ীরা ৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
সবজির ট্রাকে এখন ‘ডিজিটাল চাঁদাবাজি’
তিন সড়কে চাঁদাবাজি,
চাঁদাবাজির শিকার একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাক শহরে ঢোকে। তখন চাঁদাবাজ চক্রের সদস্যরা শহরের তিনটি প্রবেশমুখ তামাবিল-সিলেট সড়কের বটেশ্বর থেকে টিলাগড়, ভোলাগঞ্জ-সিলেট সড়কের বিমানবন্দর সড়ক থেকে আম্বরখানা এবং সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের তেমুখী বাইপাস এলাকায় ওঁৎ পেতে থাকে। ট্রাকগুলো এসব জায়গায় এলেই চক্রটি মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের সাহায্যে ব্যারিকেড দিয়ে ট্রাক ও পিকআপ থামিয়ে চাঁদা আদায় করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবজিবাহী ট্রাক থেকে মাসে দুই কোটি টাকার বেশি চাঁদা বাণিজ্য করছে ছাত্রলীগ। শহরের তিনটি প্রবেশমুখে প্রতিদিন গড়ে ছয় থেকে আট লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী কেউই বাদ যান না চাঁদাবাজি থেকে। পণ্যের পরিমাণ অনুযায়ী যানপ্রতি দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
সবজির ট্রাকে বাড়তি দিতে হয় ৯২০ টাকা
চাঁদাবাজির শিকার ১০ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে আসার সময় চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। তবে তাঁরা ভয়ে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। এর বাইরে পাঁচজন ব্যবসায়ী নেতা ও ছয়জন স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললে তাঁরাও পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, চাঁদাবাজেরা চাঁদাবাজির সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া শহরের ঠিক পাশেই চাঁদাবাজ চক্রটির এত সক্রিয় থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন তাঁরা। এর সঙ্গে পুলিশের জড়িত থাকার ইঙ্গিতও দিলেন কেউ কেউ।
অভিযোগের বিষয়ে সিলেটের পুলিশ কমিশনার মো. জাকির হোসেন খান সিলেটের কাগজ কে বলেন, ‘আমি সিলেটে নতুন যোগদান করেছি। চাঁদাবাজির বিষয়টি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জেনেছি। সম্প্রতি একটি ট্রাকের পণ্য ছিনতাইয়ের যে ঘটনা ঘটেছে, এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ চেষ্টা করছে। এ ছাড়া শহরের প্রবেশমুখে যেন কেউ চাঁদাবাজি করতে না পারে, সে জন্য পুলিশ তৎপরতা বাড়িয়েছে।’
ছাত্রলীগের অস্বীকার,
চাঁদাবাজিতে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নন বলে ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতারা সিলেটের কাগজের কাছে দাবি করেছেন। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ এবং মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইম আহমদ বলেন, ছাত্রলীগের কোনো কর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিতে সম্পৃক্ত থাকার কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। এটা অপপ্রচার।
এদিকে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ সিলেটের কাগজ কে বলেন, ‘চাঁদাবাজি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ। এ ঘটনায় একটি ছাত্রসংগঠনের নাম এলেও আমরা বিশ্বাস করি, সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই। এমনকি কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেও যোগসাজশের অভিযোগ আছে।’
প্রসঙ্গত, এর আগে ভারত থেকে চোরাই পথে আসা চিনি একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা তামাবিল-সিলেট এবং কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট সড়ক দিয়ে সিলেট শহরে নিয়ে আসতেন। একইভাবে এসব চোরাই চিনি পরিবহনকাজে ব্যবহৃত ট্রাক আটকে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগ ও পুলিশের বিরুদ্ধে। স্থানীয়ভাবে এসব চিনি ‘বুঙ্গার চিনি’ নামে পরিচিত। এ নিয়ে গত বছরের ২৪ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘সিলেটের বাজারে বুঙ্গার চিনি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর কিছুদিন পুলিশি তৎপরতার কারণে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়। তবে এখন আবারও আগের মতো চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ আছে।