বিশেষ প্রতিনিধি :
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে বিভিন্ন স্থানে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী। ১৫ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায় বীর বাঙালি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার অপেক্ষায়। হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তারা শুধু একটু ভরসা চাইছিল তখন। নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল যে, আত্মসমর্পণের সময় তাদের হত্যা করা হবে না।
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ছিল বুধবার। এদিন দেশের অধিকাংশ রণাঙ্গনে চলছিল মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্লাস। এদিন রাজধানীর বাসাবোতে এস ফোর্সের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। গাজীপুরের জয়দেবপুরেও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয় তারা। টঙ্গী, ডেমরা, গোদনাইল ও নারায়ণগঞ্জে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় দখলদার বাহিনী। এছাড়া এদিন সাভার পেরিয়ে গাবতলীর কাছাকাছি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয় মিত্রবাহিনীর একটি ইউনিট। ভারতীয় ফৌজের একটি প্যারাট্রুপার দল পাঠিয়ে ঢাকার মিরপুর সেতুর পাকিস্তানি ডিফেন্স লাইন পরখ করে নেওয়া হয়। রাতে যৌথ বাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। রাত ২টার দিকে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যের মুখোমুখি হয়। যৌথ বাহিনী সেতু দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে। সেতুর ওপাশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী মুহুর্মুহু গোলা ছুড়তে থাকে।
এ সময় যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল এসে পশ্চিম পাড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। সারা রাত তুমুল যুদ্ধ চলে। এদিকে রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী কুমিরার দক্ষিণে আরও কয়েকটি স্থান হানাদারমুক্ত করে। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম শহরের প্রথম রক্ষাব্যূহ ভাটিয়ারিতে আক্রমণ চালায়। সারা রাত মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলে। ভাটিয়ারি থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এদিন বগুড়া জেলা ও পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি শত্রুমুক্ত হয়।
পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির দেওয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর বিকালে জেনারেল মানেক শ’ হানাদার বাহিনীকে জানিয়ে দেন, শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হবে না। এ সময় প্রস্তাবের প্রতি মিত্রবাহিনীর আন্তরিকতার নিদর্শন হিসাবে ১৫ ডিসেম্বর বিকাল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে বলে পাকিস্তানি জেনারেলকে জানিয়ে দেওয়া হয়। আত্মসমর্পণ করলে মিত্রবাহিনী কোনো প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না বলেও পাকিস্তানি জেনারেলকে আশ্বস্ত করা হয়। তবে সেই সঙ্গে পাকিস্তানি জেনারেলকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে এও বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা থেকে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করা ছাড়া মিত্রবাহিনীর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।
জেনারেল নিয়াজি তাৎক্ষণিক বিষয়টি পাকিস্তান সদর দপ্তরকে জানান। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দেন, ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য তা মেনে নেওয়া যেতে পারে। নিয়াজি তাৎক্ষণিকভাবে তা ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক শ’কে জানান। দিনটি মূলত দখলদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিনক্ষণ নির্ধারণের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়।