বিশেষ প্রতিনিধি:
শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকার তৃতীয় পর্ব প্রকাশ নিয়ে শেষ মুহূর্তে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের কারো করো আন্তরিকতার অভাব ও সমন্বয়হীনতার জন্য কাজগুলো যথাসময়ে হচ্ছে না।
বুদ্ধিজীবী দিবসশহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা করার জন্য ২০২০ সালের নভেম্বরে যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়। গত তিন বছরে দুই পর্বে ৩৩৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশের পর প্রায় দেড় বছর পার হয়েছে। এখনো তৃতীয় পর্ব প্রকাশ করা হয়নি।
গতকাল বুধবার মন্ত্রণালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নসংক্রান্ত উপকমিটির একটি সভা হয়। সভায় তালিকার তৃতীয় পর্বের জন্য ২৫৯ জনের নাম নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বৈঠকে ২০২২ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গবেষণা সেল থেকে যে ৪০০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন এবং মুক্তিসংগ্রামে তাঁদের অবদান’ শীর্ষক গবেষণা করা হয়, তাঁদের নিয়েও আলোচনা করা হয়। মূলত সেই গবেষণা থেকে ১৮৭ জন এবং মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া ৭২টি নতুন আবেদন বৈঠকে পর্যালোচনা করা হয়।
উপকমিটির সদস্য গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের গতকালের সভা শেষে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সভায় আমরা গণহত্যা জাদুঘরের গবেষণায় নাম আসা ৪০০ জনের মধ্যে গেজেটভুক্ত হননি এমন ১৮৭ জনের নাম এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া ৭২ জনের নামসহ ২৫৯ আবেদন যাচাই-বাছাই করেছি। ৭২টি আবেদনের মধ্যে আমরা খুব বেশি নাম খুঁজে পাইনি যাঁদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়।
এটা নিয়ে আগামী ২৬ ডিসেম্বর আবার সভা হবে।’
দেড় বছরে মাত্র তিনটি সভা
মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত দেড় বছরে যাচাই-বাছাই উপকমিটির সভা হয়েছে মাত্র তিনটি। এর মধ্যে দুটিই হয়েছে চলতি মাসের ১১ ও ১৩ তারিখে বুদ্ধিজীবী দিবস সামনে রেখে। এর আগে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর আরেকটি সভা হয়েছিল।
গত ১১ ডিসেম্বরের সভায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সভায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতার জন্য কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির এক সদস্য কালের কণ্ঠকে জানান, বাছাই কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ১১ তারিখের সভায় প্রশ্ন তুলেছেন, এটা (সভা) বুদ্ধিজীবী দিবসের আগে মন্ত্রণালয়ের সাংবাদিকদের এড়ানোর কৌশল কি না। এমন আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন চলতি মাসেই কিছুটা তড়িঘড়ি করে তৃতীয় পর্ব প্রকাশ করতে পারে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরের শেষের দিকে অন্তত শখানেক নাম গেজেটভুক্ত করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার তৃতীয় পর্ব প্রকাশ করতে পারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বুদ্ধিজীবী দিবস সামনে রেখে তাড়াহুড়া করে তৃতীয় পর্ব প্রকাশের বিষয়টির ইঙ্গিত পাওয়া গেল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কথায়ও। তালিকা প্রণয়নে দেরি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে আ ক ম মোজাম্মেল হক গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাঝখানে আমাদের আগের সচিব সাহেব (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খাজা মিয়া, বর্তমানে ওএসডি) একটা সভাও করেননি। সে জন্য এই দেরি হয়েছে। এখন আমরা তাগাদা দিচ্ছি। আশা করছি, তালিকার কাজ এখন ত্বরান্বিত হবে।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খাজা মিয়ার ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন ও খুদে বার্তা দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেরি তো হয়েছেই। সব কিছুতেই দেরি হচ্ছে। এর বড় কারণ হলো আমাদের প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওরা (স্বাধীনতাবিরোধীরা) বসে আছে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে এখানে বেশির ভাগ সময় স্বাধীনতাবিরোধীরাই ক্ষমতায় ছিল। তার পরও এই সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগটাকে আমাদের প্রশংসা করা উচিত। কিন্তু কালক্ষেপণ করা যাবে না।’
যাচাই-বাছাই কমিটি
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয় ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর। কমিটিতে গবেষক সদস্য হিসেবে আছেন ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্য হিসেবে আছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক)। কমিটিতে সভাপতি হিসেবে আছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব। এ ছাড়া সদস্যসচিব হিসেবে গেজেট অধিশাখার উপসচিব এবং সদস্য হিসেবে আরেকজন সচিব আছেন কমিটিতে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে কমিটিতে আরো যুক্ত হন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী। কমিটির একজন সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন ২০২১ সালে মারা যান।
২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরকে আহ্বায়ক করে এই কমিটির ছয়জন সদস্যকে নিয়ে একটি উপকমিটি করা হয়। উপকমিটি খসড়া তালিকা করে তা আবার যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মূল কমিটির কাছে উপস্থাপন করে।
প্রথম দুই পর্ব
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ২০ জুন দ্বিতীয় পর্বে ১৪৩ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। ২০২১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম পর্বে ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকাশ করেন। একই বছর ২৭ মে তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। দুই পর্ব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা দাঁড়াল ৩৩৪।
দুই পর্বে ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাজনীতিবিদ ও পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সমাজসেবক নূতন চন্দ্র সিংহ, সাহিত্যিক ও শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার পাশা, সমাজসেবক ও দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারসহ প্রথিতযশা শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ অন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন।
গেজেটভুক্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নেই বিশেষ কোনো সুবিধা
গেজেটভুক্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা কোনো আর্থিক বা বিশেষ সুবিধা পান না। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বা বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়া যেতে পারে কি না—এমন প্রশ্নে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা হওয়া উচিত। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো সরকার নেবে। আমাদের দাবি থাকবে তাঁদের সেই মর্যাদা দেওয়ার।’ তিনি আরো বলেন, আর্থিক সুবিধা না হোক কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের নাম তাঁদের নামে নামকরণ করা হক। পৌর করপোরেশনগুলো করছে বিভিন্ন জেলায়। শহরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামে বিভিন্ন সড়ক বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হচ্ছে। এগুলো তো সরকারি উদ্যোগে হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই স্বীকৃতিই (শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি) তো একটা বিশেষ সম্মান। এই স্বীকৃতি দিলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ঐতিহাসিক দায়মোচন হবে। সেটুকু হোক আগে। তারপর আরো অনেক কিছু ভাবা যাবে। আমরা যেন আগে এই কাজ ঠিকভাবে করতে পারি।’