বিশেষ প্রতিনিধি:
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশে বিভাগীয় কমিশনার অফিস এ পর্যন্ত ১৫৭ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কর্মস্থল পরিবর্তন করেছে। তাদের বিভাগের ভেতরে আন্তঃজেলা পদায়ন করা হয়েছে। তবে কিছু ইউএনওকে জেলার ভেতরেই এক উপজেলা থেকে অপর উপজেলায় পদায়ন করা হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় পোস্টিংয়ে থাকা ২৭০ ইউএনওকে চিহ্নিত করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্যে ১৫৭ জনকে ইতোমধ্যে বদলি করা হয়েছে। বাকি ১১৩ জনের বদলি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর মধ্যে আবার ৪৮ জনকে ইসি সচিবালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাকি ৬৫ জন কর্মকর্তার বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা পায়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এদিকে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩৪ ও ৩৫ ব্যাচের ১৫০ কর্মকর্তাকে ইউএনও করার জন্য ফিটলিস্ট চূড়ান্ত করে রাখা রয়েছে। ইসির চাহিদার প্রেক্ষিতে যে কোনো সময় তাদের পদায়ন করা যাবে। এছাড়া এ পর্যন্ত দুই জেলার ডিসির কর্মস্থল পরিবর্তন করা হয়েছে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ডিসি শাহগীর আলমকে প্রত্যাহর করে স্থানীয় সরকার বিভাগের কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শাহগীর আলম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা এবং ওই পদে তিনি ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কর্মরত। আরও কয়েকজন ডিসি পরিবর্তনের সম্ভবনা রয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ইসি থেকে এক বছরের বেশি সময় পোস্টিং আছে এমন ইউএনওদের তালিকা চাওয়া হলে তা সরবরাহ করা হয়। বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে ওই তালিকা সংগ্রহ করে ইসিতে পাঠানো হয়। সে তালিকা থেকে ৩ ডিসেম্বর ৪৭ জন এবং ৭ ডিসেম্বর ১১০ জন ইউএনওকে বদলি করা হয়।
এক বছরের কম সময় পোস্টিং আছেন তাদের বদলি কেন করা হলো না-এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ইসি কর্মকর্তারা বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন। ইসি চাইলে এক বছরের কম সময় যারা পোস্টিংয়ে আছেন এমন ইউএনওদেরও বদলি করা হবে। এমন কি নতুন ইউএনও বা ডিসি দিতে বললেও আমরা দিতে প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন, দেশের সংবিধান অনুসারে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারী এখন ইসির অধীনে কাজ করছে। সুতরাং আদেশ আসার সঙ্গে সঙ্গে তামিল করা হবে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রথম ধাপে বদলি করা ৪৭ ইউএনওর প্রত্যেকের পোস্টিং দেড় বছরের বেশি ছিল। দ্বিতীয় ধাপে বদলি করা সবার পোস্টিং এক বছরের বেশি ছিল। ইসি চাইলে এক বছর বা তারচেয়ে কম সময় যারা পোস্টিং আছেন-এমন কর্মকর্তাদেরও বদলি করা হবে।’
বদলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৩ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার ইউএনও সাদিকুর রহমান সবুজকে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের ইউএনও হিসাবে বদলি করা হয়। তিনি ভৈরবে যোগদান করেন ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর। সেই হিসাবে তিনি ভৈরবে ২ বছর ১ মাস ছিলেন। অপরদিকে ৭ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার দোহারের ইউএনও মোবাশ্বর আলমকে শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যার ইউএনও হিসাবে বদলি করা হয়েছে। তিনি দোহারে ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যোগদান করেন। সেই হিসাবে দোহারে তিনি ১ বছর ৯ মাস কাজ করেছেন। বদলির ক্ষেত্রে তাদের ঢাকা বিভাগেই রাখা হয়েছে। শুধু জেলা পরিবর্তন করা হয়েছে।
৭ ডিসেম্বর সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ইউএনও মাহমুদুর রহমানকে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায় বদলি করা হয়েছে। তিনি দিরাইয়ে ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর যোগদান করেন। সে হিসাবে তিনি ২ বছর ১১ মাস কর্মরত ছিলেন। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ইউএনও আবু তালেবকে ৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ইউএনও হিসাবে বদলি করা হয়। ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি তাকে শাল্লায় পোস্টিং দেওয়া হয়। সে হিসাবে তিনি শাল্লায় ১ বছর ১০ মাস পোস্টিং ছিলেন। বদলির ক্ষেত্রে তাদের সিলেট বিভাগে রেখে শুধু জেলা পরিবর্তন করা হয়েছে।
রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলার গুরুদাসপুরের ইউনও শ্রাবণী রায়কে নওগাঁ জেলায় পোরশায় বদলি করা হয়েছে। তাকে গুরুদাসপুরে ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পদায়ন করা হয়। সে হিসাবে তিনি ১ বছর ২ মাস কর্মরত ছিলেন। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার ইউএনও উজ্জ্বল হোসেনকে ৭ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাগমারায় বদলি করা হয়। তাকে ২০২২ সালের ২১ মার্চ উল্লাপাড়া পদায়ন করা হয়। সে হিসাবে তিনি উল্লাপাড়ায় ১ বছর ৮ মাস কর্মরত ছিলেন।
বলিশাল বিভাগের ভোলা সদর উপজেলার ইউএনও তৌহিদুল ইসলামকে লালমোহন উপজেলায় পদায়ন করা হয়েছে। তিনি ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি ভোলা সদরে যোগদান করেন। সে হিসাবে সেখানে ১ বছর ৯ মাস পোস্টিং ছিলেন। অর্থাৎ ভোলা সদরের ইউএনওকে জেলার ভেতরেই রাখা হয়েছে।
একই ভাবে সুনামগঞ্জ সদরের ইউএনও সালমা পারভীনকে একই জেলার তাহিরপুরে, ময়মনসিংহ সদরের ইউএনও শফিকুল ইসলামকে একই জেলার গফরগাঁও উজেলায়, ফুলবাড়িয়া উপজেলার ইউএনও মোহাম্মদ নাহিদুল করিমকে গৌরিপুর উপজেলায়, হালুয়াঘাটের ইউএনও মাহমুদা হাসানকে মুক্তগাছায় এবং গফরগাঁয়ের ইউএনও মো. আবিদুর রহমানকে হালুয়াঘাটের ইউএনও হিসাবে বদলি করা হয়েছে। জেলা পরিবর্তন না করে শুধু উপজেলা পরিবর্তন করা হয়েছে।
পুলিশ প্রশাসনে রদবদল : নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ৭ ডিসেম্বর সারা দেশের ৩৩৮ জন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) একযোগে বদলি/পদায়ন করা হয়। বদলির আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঢাকাসহ মেট্রোপলিটন এলাকার ওসিদের আগের মেট্রোপলিটন এলাকাতেই রাখা হয়েছে। শুধু এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি করা হয়েছে। একইভাবে জেলার ক্ষেত্রে ওসিদের আগের জেলাতেই রাখা হয়েছে। শুধু সংশ্লিষ্ট জেলার এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে থানার সংখ্যা ৬৩৬টি। বেশিরভাগ থানাতেই তিনজন করে ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) পদমর্যদার কর্মকর্তা কর্মরত। তাদের মধ্যে একজন ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ইন্সপেক্টরদের পদের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। ওসিদের কর্মস্থল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অনেক ওসিই বছরের পর বছর একই পদে দায়িত্ব পালন করছেন। থানা পরিবর্তন হলেও তারা একই দায়িত্বে থাকছেন। এ কারণে ইন্সপেক্টর হওয়ার পরও অনেকেই ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাচ্ছেন না।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের রদবদলকে অর্থহীন ও রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মাঠের কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করে তেমন মৌলিক কিছু পরিবর্তন হয় না। সরকার তাদের যেভাবে পরিচালনা করতে চাইবে, যে রকম নির্বাচন করতে চায় সেটাই হবে। এর বাইরে অন্য কিছু নেই। তিনি মনে করেন, ঢালাওভাবে বদলি করা হলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়। তবে নির্বাচন শুরু হলে কোনো কর্মকর্তা যদি কোনো প্রার্থীর পক্ষে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন, অপর প্রার্থী যদি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মাঠপ্রশাসন থেকে ওই কর্মকর্তাকে বদলি করা হবে যুক্তিযুক্ত।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের ঢালাও রদবদল নির্বাচন কমিশনের সুচিন্তিত কোনো কাজ নয়। এটা এক ধরনের আইওয়াশ। লোক দেখানো কাজ। মাঠপ্রশাসনে রদবদলের প্রভাব এ নির্বাচনে পড়ুক বা না পড়ুক প্রশাসনে নেতিবাচক একটি প্রভাব পড়বে। কর্মকর্তারা ডিমরালাইজড হয়ে যাবে। এত ব্যাপক হারে বদলি নিষ্প্রয়োজন। নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু সংখ্যক বদলি করাই যথার্থ ছিল। ৩০ নভেম্বর ইসি ইউএনও এবং ওসিদের বদলির ঘোষণা দেয়। ওই দিনই নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দিয়ে ইউএনও এবং ওসিদের তালিকা চাওয়া হয়।