স্টাফ রিপোর্টার:: –
আজ ৮ ডিসেম্বর আজমিরীগঞ্জ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ ইং সনের এই দিনে আজমিরীগঞ্জকে হানাদার মুক্ত করে স্থানীয় গরুরবাজার মাঠে বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন গেরিলা বাহিনীর তথা দাসপার্টি’র সেকেন্ড ইন কমান্ড জগন্নাথপুরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান ( শফিক) পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াছ চৌধুরী, ধন মিয়া, অক্ষয় বৈষ্ণব, ব্রজলাল গোপ নৈমুল্লা, আঃ রশিদ সহ দাসপার্টির অন্যান্য সদস্যসহ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ডা, কৃপেন্দ্র কিশোর বর্মন, ডা, যামিনী কুমার দাস, মাহতাব আলী খাঁন, নলিনী কান্ত ব্যানার্জী, নূর মিয়া সহ এলাকার শত শত মুক্তিকামী জনতা উপস্থিত ছিলেন। একই দিন বিকাল অনুমানিক ৪ টায় একই স্থানে মোঃ মাহতাব আলী খাঁনের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত গণ সমাবেশে আজমিরীগঞ্জকে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস ( বীর উত্তম) এর নামে জগৎজ্যোতিগঞ্জ নামকরণের দাবি জানানো হয়। হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের ভাটি এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জগৎজ্যোতি দাস ( বীর উত্তম) কে বাদ দিয়ে লিখলে তা অসম্পূর্ণ-ই থেকে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতের মেঘালয়ের ইকো-১ প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেন জগৎজ্যোতি দাস।
একসময়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে পড়া অবস্থায় নকশালপন্থীদের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। তাই -অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে ধারণা ছিল তার। ইকো-১ প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণের পর পরবর্তীতে গণযোদ্ধাদের নিয়ে জগৎজ্যোতি দাস গড়ে তোলেন ‘দাস পার্টি’ নামের দুর্ধর্ষ গণবাহিনী। জগৎজ্যোতি ইংরেজি, হিন্দি, গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষা জানতেন বলে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ছিল তার। ভারতীয় বাহিনী থেকেও বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদও সংগ্রহ করেন জগৎজ্যোতি দাস।
এরপর সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণা ও হবিগঞ্জের হাওর অঞ্চলে একের পর এক অপারেশন চালাতে শুরু করেন জগৎজ্যোতি দাস ও তার নেতৃত্বাধীন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল জগৎজ্যোতি দাসের ওপর। সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌ-পথ হানাদার দখলমুক্ত রাখার জন্য অসংখ্য অপারেশন চালিয়েছিলেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।
ক্রমেই দাস পার্টি হয়ে উঠল পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে আতঙ্কের নাম। একসময় বাধ্য হয়ে হানাদার বাহিনী রেডিওতে ঘোষণা দেয় ‘এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না।
মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটিঅঞ্চল শত্রু মক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল জগৎজ্যোতি দাস ও তার বাহিনীর উপরে।মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস দখল করে আছে ২৯ জুলাইয়ের জামালগঞ্জ রেইড। এই যুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। অবস্থানগত কারণে জামালগঞ্জের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যার ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করেছিল জামালগঞ্জে। জামালগঞ্জের পাশ দিয়েই ছিল সুরমা নদী। নদীর এক পাড়ে জামালগঞ্জ থানা সদর অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ সাচনাবাজার বন্দর।জামালগঞ্জ থানা ও নৌ-বন্দর সাচনাবাজারকে হানাদারদের হাত থেকে শত্রুমুক্ত করার জন্য জামালগঞ্জে রেইড চালানোর সিদ্ধান্ত নেন ৫ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী। সে অনুযায়ী ২৯ জুলাই অপারেশনের দিন ধার্য করে রেকি করা হয়। প্রায় ১৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনটি দলে বিভক্ত করে ৬টি নৌকা করে অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন জগৎজ্যোতি দাসসহ মুক্তিযোদ্ধারা। রাত ১২টায় নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়ে জগৎজ্যোতি দাস সহ মুক্তিযোদ্ধারা সমন্বিতভাবে অতর্কিত আক্রমণ চালান হানাদার বাহিনীর উপর। এসময় হানাদার সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের ধারণাই ছিল না জগৎজ্যোতির “দাসপার্টি ” এমন আক্রমণ চালাতে পারে। একপর্যায়ে হানাদারেরা ঘুরে দাঁড়ালেও জগৎজ্যোতি দাসের রণ কৌশলের কাছে হেরে যায় হানাদারেরা। শেষরাতের দিকে একপর্যায়ে হানাদার সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।এই রেইডেই জগৎজ্যোতি দাসের নির্দেশে সিলেট- সুনামগঞ্জের সড়কের বদলপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা। বদলপুরের যুদ্ধ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে একপর্যায়ে দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে টিকতে না পেরে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা চালিয়েছিল হানাদারেরা।মুক্তিযুদ্ধের আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে জগৎজ্যোতির রণকৌশলের কারণে পাহাড়পুড়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন অসংখ্য গ্রামবাসী। একই মাসে সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লায় রেইড চালিয়ে জগৎজ্যোতির দাসের নেতৃত্বে দাশ পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁদে ফেলে ১০ রাজাকারকে আটক করেন। একই সঙ্গে রানীগঞ্জ ও মার্কুলি (কাদিরগঞ্জ) অভিযান চালিয়েছিলেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের ১৬ অক্টোবর জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বার্জে আক্রমণ চালালে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। এছাড়া পাহাড়পুর অপারেশন, বানিয়াচংয়ে কার্গো বিধ্বস্ত করেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।
দাস পার্টির একেরপর এক চোরাগুপ্তা হামলা ও সফল অপারেশনে হানাদারেরা ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় জগৎজ্যোতি দাস ও তার প্রতিষ্ঠিত দাস পার্টির বীরত্ব-গাঁথা ও অবিস্মরণীয় সব কীর্তি।এরপরই পাকিস্তানি হানাদার সেনারা জগৎজ্যোতি দাসকে ধরার জন্য ওৎ পেতে থাকতে শুরু করে। একই সঙ্গে রাজাকারদের মাধ্যমে জগৎজ্যোতি দাসের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করে।সবে ভোর হয়েছে। সূর্য উঠেনি তখনও।
ভোরের সূর্য উঠার আগেই ৪২ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন জগৎজ্যোতি দাস। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটলো। অগ্রহায়ণের ঘাসে ভেজা শিশির মাড়িয়ে চলছে মুক্তিযোদ্ধারা। গন্তব্য বানিয়াচংয়ের বাহুবল। কিন্তু পথে বদলপুরে পরিস্থিতি না বুঝতে পেরেই হানাদার বাহিনীর ফাঁদে পা দেন দাসপার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।
মূলত বদলপুরে পৌঁছালে তাকে দেখে চিনতে পারে রাজাকারেরা। তাই কয়েকজন রাজাকার ব্যবসায়ীরা নৌকা আটকিয়ে চাঁদা আদায় করতে গেলে, দাস পার্টির কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাস রাজাকারদের ধরে আনার নির্দেশ দেন। এদিকে অবস্থা বুঝতে পেরে সময়ক্ষেপণের জন্য রাজাকারেরা পিছু হটে। কিন্তু বুঝতে না পেরে এই ফাঁদেই পা দেন জগৎজ্যোতি দাস। তিনি বুঝতেই পারেননি কোনো ফাঁদে পা দিতে চলেছেন তিনি। এসময় রাজাকারদের পিছু হটতে দেখে তিনি ও তার সহযোদ্ধাদের রাজাকারদের তাড়া করতে শুরু করেন। এদিকে তখন দূরে গোয়েন্দা মারফতে খবর পেয়ে জগৎজ্যোতি দাসের জন্যই অপেক্ষা করছিল হানাদার বাহিনী। একসময় জগৎজ্যোতি দাস বুঝতে পারেন তিনি হানাদারদের তৈরি গোলকধাঁধার ব্যূহে ঢুকে পড়েছেন। হানাদারদের বিশাল বহর চারপাশে ঘিরে ফেলেছে তার বাহিনীকে। কিন্তু এর মধ্যেও দমে যাননি জগৎজ্যোতি। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন সহযোদ্ধাদের। কিন্তু একটা সময় তিনি দেখলেন আসলে এভাবে সম্ভব না। এভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে সবাই শহীদ হবেন। তখন জগৎজ্যোতি সহযোদ্ধাদের সরে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে সহযোদ্ধা ইলিয়াসকে দিয়ে একটানা গুলি বিনিময় চালিয়ে যান।কিন্তু হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে সহযোদ্ধা ইলিয়াসের গায়ে। তখন জগৎজ্যোতি নিজের গামছা খুলে বাঁধেন সহযোদ্ধা ইলিয়াসের ক্ষতস্থান। এসময় ইলিয়াস জগৎজ্যোতিকে সরে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু যাননি জগৎজ্যোতি। তিনি এরপর একাই যুদ্ধ চালিয়ে যান। তার সঙ্গে গুলিবিনিময়ে ততক্ষণে ১২ জন হানাদার সেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। বিকেলের আলো মরে এসেছে। সূর্য ঢলে পড়বে আরেকটু পরে, ঠিক তখনই জগৎজ্যোতি দেখতে পেলেন গুলি ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। এমন সময় গুলির ম্যাগাজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করাতে ১টি গুলি এসে বিদ্ধ হয় জগৎজ্যোতির চোখে। লুটিয়ে পড়েন জগৎজ্যোতি দাস। একপর্যায়ে শহীদ হন এ ক্ষণজন্মা বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস। ওই দিনটি ছিল, বিজয়ের ঠিক ১ মাস পূর্বে অর্থাৎ ১৯৭১ ইং সনের ১৬ নভেম্বর। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জগৎজ্যোতি দাস ( বীর উত্তম) শহীদ হওয়ার পর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দ্বায়িত্ব পান বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান,শফিক। দ্বায়িত্ব পাওয়ার ২১ দিন পর ” দাসপার্টি ” র সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ ইং সনের ৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ আজকের এই দিনে আজমিরীগঞ্জকে হানাদার মুক্ত ঘোষনা করা হয়।