শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত শিশু ও নবজাতক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শয্যাসংখ্যার বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। নবজাতকদের বিশেষায়িত সেবাকেন্দ্রে (স্ক্যানু) নির্ধারিত সিটের প্রায় সাত গুণ রোগী ভর্তি ছিল গতকাল শনিবার। কিন্তু সেখানকার অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট।
স্ক্যানুতে গত আট দিনে ১৪ নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে ঠাণ্ডাজনিত রোগে। এর মধ্যে গতকাল সকালে এক নবজাতকের মৃত্যু হয়।
গতকাল হাসপাতালে দেখা যায়, শিশু ওয়ার্ড, স্ক্যানু ও বহির্বিভাগ—সবখানেই শিশু রোগীর সংখ্যা বেশি। শিশু ওয়ার্ড ও স্ক্যানুর মেঝেতেও শয্যা পেতে রোগী রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পুরনো ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত স্ক্যানুতে নবজাতক নিয়ে স্বজনদের দীর্ঘ লাইন। স্ক্যানুসংলগ্ন কক্ষটি নবজাতকের মা এবং স্বজনদের ভিড়ে ঠাসা। স্ক্যানুতে ১১টি সিট থাকলেও দুটি নষ্ট। গতকাল দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সেখানে ভর্তি ছিল ৬২ নবজাতক।
এর মধ্যে সকালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের ছামাদ মিয়া নামে এক ব্যক্তির নবজাতকের মৃত্যু হয়। স্বজনদের কান্নায় সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। আগের দিন শুক্রবার সেখানে তিন নবজাতকের মৃত্যু হয়। ১৮ থেকে ২৫ নভেম্বর (শনিবার) পর্যন্ত ১৪ নবজাতক মারা যায়। এর মধ্যে ১৮, ২২ ও ২৪ নভেম্বর তিনটি করে নবজাতকের মৃত্যু হয়।
স্ক্যানুর রেজিস্টার থেকে দেখা যায়, নভেম্বর মাসের এ পর্যন্ত সেখানে ৩৬ নবজাতক মারা গেছে। অক্টোবর মাসে মারা যায় ৩২ শিশু।
স্ক্যানুতে দায়িত্বরত নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে ১১টি ওয়ার্মার সিটের মধ্যে দুটি নষ্ট। ৯টি সিটে নবজাতকদের ভাগ করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ফটোথেরাপির তিনটি মেশিনের মধ্যে দুটি ভালো, একটি নষ্ট। নেই কোনো ইনকিউবেটর।
শিশু ওয়ার্ডে শনিবার ভর্তি ছিল ১৮২ শিশু। অথচ সেখানে সিট আছে ৫৯টি। ভর্তি রোগীর বেশির ভাগই নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার। সেখানে রোগীদের সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নার্সদের।
হাসপাতালের আউটডোরে যোগাযোগ করলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মাসুদ রানা জানান, প্রতিদিন সেখানে ৩০০টির বেশি শিশু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। বেশির ভাগই ঠাণ্ডাজনিত রোগী। আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্যই রোগীর সংখ্যা বেশি।
হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. দেবাশীষ দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগ বেড়েছে। ফলে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা বেশি। স্ক্যানুতে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হলো এখানে যেসব নবজাতক আসে, তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ থাকে। সাধারণত গ্রামে অদক্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে ডেলিভারির (প্রসব) জন্য নবজাতককে মুমূর্ষু অবস্থায় এখানে আনা হয়। আর শীতকালে ডেলিভারি বেশি থাকে। রোগীও বেশি হয়। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। তবে স্ক্যানু নবজাতকের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন এনআইসিইউয়ের।
ডা. দেবাশীষ আরো বলেন, শিশুদের যাতে ঠাণ্ডা না লাগে সে জন্য মা-বাবাকে সচেতন থাকতে হবে। রাতে বিছানায় যাতে প্রস্রাব না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের ভিটামিন ‘সি’যুক্ত খাবার দিতে হবে। আর গর্ভবতী মাকে নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর কাছে যেতে হবে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আমিনুল ইসলাম সরকার জানান, শিশু ও গাইনি ওয়ার্ডে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। স্ক্যানুতে নষ্ট যন্ত্রপাতি দ্রুতই মেরামত করা হবে।
জেলা সদর হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতির আজীবন সদস্য ও সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য জহিরুল হক শাকিল বলেন, হাওর অঞ্চলের দরিদ্র লোকজনের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল এই সদর হাসপাতাল। শুধু হবিগঞ্জ নয়, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার কিছু এলাকার লোকজনও এখানে আসে। তাই এখানকার শিশুমৃত্যুর হার কমাতে এবং চিকিৎসাসেবা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে বিষেশায়িত শিশু হাসপাতাল করা দরকার।