Sunday, November 24, 2024
Homeইসলামওয়াজ হউক হেদায়েতের, সুরের নয় আওয়াজ নয়

ওয়াজ হউক হেদায়েতের, সুরের নয় আওয়াজ নয়

স্টাফ রিপোর্টার, ইয়াছিন আলী খান।

আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে ওয়াজ মাহফিলের বিশেষ অবস্থান রয়েছে। ওলামায়ে কেরামের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আর কারিদের সুমধুর তিলাওয়াত ছাড়া শীতের মৌসুম যেন কল্পনাই করা যায় না।

 

এ সময়টাতে মাদ্রসার ছাত্র-শিক্ষকের পাশাপাশি সাধারণ মুসল্লিদের মাঝেও এক ধরনের উচ্ছ্বাস বিরাজ করে। সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে তারা আয়োজন করেন ওয়াজ মাহফিল। করোনার অযাচিত প্রাদুর্ভাব না থাকলে এ বছরও হয়তো শিগ্গির ওয়াজ মাহফিলের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে।

 

সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নে ওয়াজ মাহফিলের ভূমিকা অপরিসীম। বাস্তবিক অর্থে প্রকৃত বক্তা বা আলোচকই পারেন হৃদয়ছোঁয়া কথামালার মাধ্যমে ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে। বিবেক জাগানিয়া আলোচনা করে ঝিমিয়ে পড়া সমাজকে প্রাণবন্ত করতে।

 

দীপ্তিময় ভাষণ দিয়ে হীনমন্য জাতির অন্তরে সাহসের সঞ্চার করতে। নিশ্চয়ই তারা পারেন, কুফুরের অন্ধকারে আচ্ছন্ন কলবে ইমানের আলো জ্বালতে। সুতরাং ওয়াজ মাহফিলের প্রয়োজনীয়তা ও আবশ্যিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

 

যে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ কাজকে সার্থক ও ফলপ্রসূ করতে হলে যথাযথ নীতিমালার অনুসরণ অপরিহার্য। ওয়াজ মাহফিলও এর ব্যতিক্রম নয়। কেবল জমকালো আয়োজন আর বড় মাপের কালেকশনই সফলতার মানদণ্ড হতে পারে না।

 

মৌলিক লক্ষ্য সাধন করতে না পারলে বাহ্যিক আড়ম্বরের কোনো মূল্য থাকে না। জ্ঞানগর্ভ আলোচনার পরিবর্তে সুরসর্বস্ব আলোচনা দিয়ে সমাজ সংস্কার করা যায় না। এসব বিষয়ে লক্ষ রাখা মাহফিল কর্তৃপক্ষের জন্য একান্ত জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ার ফলোয়ার সংখ্যার ভিত্তিতে আলোচকের মান যাচাই না করে ইলমি মাকাম ও আমলি মানের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

 

এ কথা সত্য যে, শারীরিক চিকিৎসায় যেমন মানসম্মত ডাক্তারের বিকল্প নেই তেমনি আত্মার চিকিৎসায়ও মুত্তাকি, পরহেজগার আলেমের বিকল্প নেই। হজরত মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রহ.) বলেন, নিশ্চয়ই কুরআন হাদিসের ইলম অর্জন করা দ্বীনের অংশ।

 

অতএব, যার কাছ থেকে দ্বীন অর্জন করবে তাকে পরখ করে নিও (মুকাদ্দামা মুসলিম)। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইলমে দ্বীন অর্জনের আগে শিক্ষক নির্বাচন করা যেমন অপরিহার্য তেমনি ওয়াজ মাহফিলের আলোচকের ক্ষেত্রেও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ রাখা আবশ্যকীয়।

 

একজন আলোচকের মাঝে যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় তা হলো; ইলম, আমল, আকিদা, আদর্শ এবং চারিত্রিক গুণাবলি। আল্লাহ পাক নবী কারিম (সা.)কে সম্বোধন করে বলেন, বলে দিন, এটাই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীরা আল্লাহর পথে আহ্বান করি। পরিপূর্ণ ইলম ও বিশ্বাসের সঙ্গে। আল্লাহ পূতপবিত্র। আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই (সূরা ইউসুফ-১০৮)।

 

অন্যত্র এরশাদ করেন, কেন প্রতিটি সম্প্রদায় থেকে একদল লোক বের হয় না? যাতে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে স্বজাতির কাছে ফিরে এসে তাদেরকে সচেতন করে। যেন তারা বাঁচতে পারে (সূরা তাওবা-১২২)। ওই আয়াতদ্বয় থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া ও ধর্মীয় আলোচনা করার আগে অবশ্যই উপযুক্ত জ্ঞান অর্জন করে নিতে হবে। যেন আলোচক নিজেই তদসংশ্লিষ্ট সমূদয় আপত্তির সমাধান দিতে পারেন।

 

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বান্দার অন্তর থেকে সহসা ইলম ছিনিয়ে নেবেন না। বরং ওলামায়ে কেরামকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নেবেন। অতঃপর এমন একটি সময় আসবে যখন প্রকৃত আলেম বলতে কেউ থাকবে না।

 

তখন লোকজন মূর্খ ব্যক্তিদের ধর্মীয় নেতা নির্বাচন করবে। তাদের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হবে। তখন তারা মূর্খতাপূর্ণ ফতওয়া দিয়ে নিজেদের সঙ্গে সমাজেরও সর্বনাশ ঘটাবে (বুখারি, মুসলিম)। এ হাদিসে রাসূল (সা.) কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ের দৃশ্যায়ন করতঃ জ্ঞানবহির্ভূত ফতওয়া প্রদানের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন।

 

এ থেকে বোঝা যায় যে, একজন আলোচক ও ধর্মীয় প্রদর্শকের জন্য দ্বীনের গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করা কতটা জরুরি। আমলের ব্যাপারে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন, তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের আদেশ দাও এবং নিজেদের বেলায় ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর?

 

তোমরা কি চিন্তা করো না? (সূরা বাকারা-৪৪)। অপর আয়াতে বলছেন, মুমিনগণ! তোমরা কেন এমন কথা বল যা তোমরা কর না? তোমরা যা কর না তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক (সূরা সাফ-২,৩)।

 

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, শেষ জামানায় একদল লোক বের হবে, যারা হবে বয়সে অল্প, বিদ্যায় অপরিপক্ব। তারা কুরআনের কথা বলবে কিন্তু এর প্রভাব নিজ কণ্ঠনালি অতিক্রম করবে না। (অর্থাৎ বাস্তব জীবনে এর ওপর আমল করবে না।) তারা দুনিয়াবাসীর মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার চমৎকার কথা বলবে। অথচ ধনুক থেকে তীর ছোটার গতিতে তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে (তিরমিযী)।

 

এ হাদিসে আমলহীন আলোচকের ব্যাপারে সতর্ক করার পাশাপাশি তাদের ভয়াবহ পরিণামের কথাও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং, দ্বীনি আলোচক নির্বাচনে অবশ্যই তার ফিকহি প্রজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে আমলি হালচাল জেনে নেওয়া আবশ্যকীয়।

 

আর চারিত্রিক সৌন্দর্য এমন একটি বিষয় যা ছাড়া কেউ ইসলামের প্রকৃত দাঈ বা মুবাল্লেগ হতে পারে না। ওয়াজ মাহফিলের আলোচকও প্রকৃতপক্ষে একজন দাঈ ও মুবাল্লেগ। বাস্তবিক অর্থে যিনি ওয়াজ-নসিহত করেন, হেদায়াতের কথা বলেন তিনি হলেন নবীওয়ালা কাজের উত্তরাধিকারী। সুতরাং অবশ্যই তাকে চারিত্রিক মাধুর্য ও আদর্শিক গুণাবলির অধিকারী হতে হবে।

 

রাসূল (সা.) বলেন, প্রশংসনীয় গুণাবলিতে পূর্ণতার রূপ দেওয়ার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি। হজরত মুয়ায (রা.) বর্ণনা করেন, আমি যখন উটের পাদানিতে পা রাখি তখন রাসূল (সা.) সর্বশেষ যে নসিহত করেছিলেন তা হলো, হে মুয়াজ! তুমি মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করবে (মুয়াত্তা মালেক)।

 

সুতরাং, কেউ নিজেকে রাসূলের অনুসারী ও উত্তরাধিকারী বলে দাবি করবে অথচ চারিত্রিক গুণাবলিতে তার আনুগত্য করবে না, তা হতে পারে না। সুতরাং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক চলাফেরায় সর্বত্র নববী আদর্শের বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

 

আলোচনার বিষয়বস্তু নির্ধারণেও সতর্কতা কাম্য। এ ব্যাপারে হজরত আলী (রা.) বলেন, সাধারণ মানুষের সামনে এমন বিষয় আলোচনা করো যা তারা অনুধাবন করতে পারে। তোমরা কি চাও আল্লাহ ও তার রাসূল কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হোক? (বুখারি)।

 

অর্থাৎ এমন বিষয় আলোচনা করো যা তাদের ধারণক্ষমতার মধ্যে হয়। কেননা যদি তারা অনুধাবন করতে না পারে তাহলে আল্লাহ ও রাসূলকে অস্বীকার করে বসবে! এ ব্যাপারে হজরত ইবনে মাসঊদ (রা.) বলেন, তুমি যদি শ্রোতার ধারণক্ষমতার ঊর্ধ্বের কোনো বিষয় আলোচনা করো তাহলে তা ফিতনার কারণ হবে (মুসলিম)।

 

সারকথা হলো, ওয়াজ নসিহত করার ব্যাপারটি যেমন সম্মানজনক তেমন স্পর্শকাতরও। যে কেউ তা করতে পারে না। করা উচিতও নয়। সে জন্য নির্ধারিত নিয়মনীতি, বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ বাস্তবায়ন পূর্বক ওয়াজে অংশগ্রহণ করা জরুরি। তা না হলে হেদায়াতের পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। অনাস্থা ও অবিশ্বাস জন্ম নেবে। সাধারণের সঙ্গে আলেমদের দূরত্ব বাড়তে থাকবে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যদিও বিগত কয়েক বছর ধরে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে এক ধরনের নাটকীয়তা লক্ষ করা যাচ্ছে।

 

যে মাহফিলগুলোয় ইলম ও আমলের আলোচনা হওয়ার কথা ছিল সেখানে চলছে সার্কাসের অভিনয়। যেখান থেকে ইসলামি জাগরণ সৃষ্টি হওয়ার কথা সেখান থেকে বিদ্বেষ ও বিদ্রোহের বার্তা দেওয়া হচ্ছে। যে বয়ান শুনে অমুসলিমরাও ইসলামের দিকে ধাবিত হওয়ার কথা ছিল সেই বয়ান কেবল বিদ্রুপেরই উদ্রেক করছে। তাই এ থেকে সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।

 

আমাদের দেশে শীতকালীন ওয়াজ মাহফিলের সূচনা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে জানা নেই। তবে যে বা যারা যখন থেকেই শুরু করেছেন, নিশ্চয়ই সাধারণ জনগণের দ্বীনি উপকারের কথা বিবেচনা করেই শুরু করেছেন। ঢাউস কালেকশন বা প্রসিদ্ধি অর্জন তাদের লক্ষ্য ছিল না। ছিল না রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কোনো উদ্দেশ্য। তাই তো পূর্বেকার মাহফিলগুলোয় আলোচনা করতেন আত্মার চোখ খোলা ওলামায়ে কেরাম, বুজুর্গানে দ্বীন ও ইলমের সাগরতুল্য ব্যক্তিবর্গ।

 

যাদের কথায় সাহিত্যের ঝংকার, সুরের মূর্ছনা বা ভরাট কণ্ঠের তর্জন গর্জন ছিল না। ছিল না কথায় কথায় মসনদ উলটিয়ে দেওয়ার হুমকিও। তারা কথা বলতেন সাদামাটা। ভাষা হতো মার্জিত, নম্র ও হৃদয়ছোঁয়া। দলাদলি, গালাগালি বা অহমিকা প্রদর্শন করতেন না। যা বলতেন ইখলাসের সঙ্গে বলতেন। ফলে তাদের বয়ান শুনে বেআমলিরা আমলি হতো। ইলমপিপাসুরা পিপাসা মেটাত। দ্বীনহীনরা পেত হেদায়াতের আলো।

 

দেখতে দেখতে সেই সময়টা হারিয়ে গেল। ওয়াজ হয়ে গেল নিরেট আওয়াজসর্বস্ব। মাহফিলগুলো রূপ নিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। বয়ানের পেছনে শোনা যেতে লাগল টাকা-পয়সার ঝনঝনানি। ইলম, আমল বা রুহানিইয়াত তো দূর কী বাত!! মাঠ জমাতে পারাই হয়ে গেল আলোচকের একমাত্র বৈশিষ্ট্য!!!

 

যার ফলে নবম, দশম শ্রেণি পাশ নাবালেগ ছোকরারাও দাওয়াত পেতে লাগল। অথচ সুর না থাকার দরুন শায়খুল হাদিস বা প্রধান মুফতি সাহেবও অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে লাগলেন।

 

প্রকৃত আলেমরা রয়ে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। এ সময় কেবল বাকপটুতার যোগ্যতা বলে একদল আলেম নামধারী প্রবচকের উত্থান হয়। যাদের আলোচনার একমাত্র প্রতিপাদ্য ছিল মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা করা। নাটকীয় অঙ্গভঙ্গি করে বিনোদন দেওয়া। ফলে অল্প দিনের ব্যবধানে দ্বীনদরদি মানুষের অন্তরে ওয়াজ মাহফিলের আবেদন কমতে থকে।

 

পূর্বেকার মান-মর্যাদা হারিয়ে পরিণত হয় নিছক নাট্যমঞ্চে। সাম্প্রতিক সময়ে আলেমদের ওপর এক ট্র্যাজেডি বয়ে গেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যদিও অনেকের জন্য তা পীড়াদায়ক ছিল। তথাপি জাতীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এর উপকারিতা কম নয়। নামসর্বস্ব ওয়ায়েজদের লাগামছাড়া কথাবার্তায় আবেগী তরুণদের অন্তরে বিদ্রোহাত্মক যে মনোভাব তৈরি হয়েছিল এখন তা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে জাতি।

 

এখন প্রেক্ষাপট বদলেছে। এখনই সচেতন হই। ওয়াজের নামে আওয়াজ ব্যবসাকে না বলি। সত্যিকার ওলামায়ে কেরামরা যেভাবে এসব মাহফিলের সূচনা করেছিলেন তাকে আবারও সেই মানদণ্ডে উন্নিত করি। সর্বোপরি, ওয়াজকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম নয় বরং আত্মসংশোধনের মাধ্যম মনে করি। তাহলে নিশ্চয়ই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। ওলামায়ে কেরামের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তৈরি হবে আলেম সমাজ ও সাধারণ জনগণের মাঝে অভূতপূর্ব মেলবন্ধন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments