বিশেষ প্রতিনিধি:
গ্রেপ্তার এড়াতে সিলেটে বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বাড়ি ছাড়া। দলীয় কর্মসূচিতে ভয়ডর নিয়েই অংশ নিচ্ছেন তারা। ফলে চলমান অবরোধ কর্মসূচি গতি হারাচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত আসামি করায়- কে মামলার আসামি, কে আসামি নয়, তা জানেন না তারা।
ফলে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন তারা। তাদের দাবি, তৃণমূল নেতাদের বাড়িতে প্রতিদিন দুই-তিন বার করে যাচ্ছে পুলিশ। বাড়িতে তাদের না পেয়ে পরিবারের লোকজন হয়রানি, এমনকি নারীদেরও হুমকি ধামকি দিয়ে আসছে তারা।
মূলত গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের পর থেকে প্রথমে হরতাল এরপর থেকে বিরতি দিয়ে দিয়ে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি দিচ্ছে দলটি।
কর্মসূচি পালনে গিয়ে মামলার আসামি হচ্ছেন- গ্রেপ্তার হচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
সিলেট জেলা ও মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ দিনে সিলেটে ২৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে ৪৮৫ জনকে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে সহস্রাধিক।
এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৮ জনকে।
সিলেট মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ২৮ অক্টোবরের পর থেকেই পুলিশ দলের শীর্ষ নেতাদের বাসা থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাদের বাড়িতে প্রতিদিন রাতে অভিযান চালাচ্ছে। কারো কারো বাড়িতে প্রতিদিন দুই তিনবার করেও যাচ্ছে পুলিশ। এতে তাদের পরিবারের লোকজন আতঙ্কে দিন পার করছেন। সহস্রাধিক অজ্ঞাত আসামি করায় কে আসামি কে আসামি না তাও বুঝতে পারছেন না নেতাকর্মীরা।
তাই শীর্ষ নেতাদের থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও বাড়ি ছাড়া।
এ বিষয়ে জানতে সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন এবং সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে মহানগর বিএনপির সর্বশেষ আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত দলের অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে পদধারী ৩০ জন নেতা রয়েছেন।’
আন্দোলনকে বানচাল করতে পুলিশ এসব মামলা ও গ্রেপ্তার করছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘এসব মামলার সঙ্গে স্থান, কাল, পাত্রের কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। বিগত নির্বাচনের আগেও আমরা এরকম মামলা দেখেছি। তখনো অসংখ্য মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অসংখ্য অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এত অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে মামলা কিভাবে হয় জানি না। মামলা হলে কিছু প্রত্যক্ষদর্শীও থাকতে হয়। সেসব কারা? তাদের নামধাম লাগে না?’ মূলত দলে যারা সংগঠিত ও নেতৃত্ব দিতে পারেন তাদের এসব মামলার মূল লক্ষ্য বানানো হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ প্রতিদিন দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে একাধিকবার করে হানা দিচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে দলের সব নেতাকর্মী বাড়ি ছাড়া।
সিলেট মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সিলেট মহানগর পুলিশের ৬টি থানায় ১৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে অবরোধ চলাকালে গাড়ি ভাঙচুর করায় দুজন ব্যক্তি ২টি মামলা করেন। বাকি মামলাগুলো পুলিশ করেছে। এর মধ্যে এসএমপির কোতোয়ালি থানায় ৫টি, জালালাবাদ থানায় ১টি, বিমানবন্দর থানায় ১টি, দক্ষিণ সুরমা থানায় ৬টি, শাহপরান থানায় ১টি এবং মোগলাবাজার থানায় ৩টি দায়ের হয়েছে। এসময় মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ১৯৮ জনকে। এর মধ্যে এজাহারে নাম উল্লেখ কাছে ৩৮৬ জনের। বাকিরা অজ্ঞাত আসামি। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫০ জন। তাদের মধ্যে ২১ জনের নাম মামলার এজাহারে আছে বাকি ২৯ জন অজ্ঞাত।
এসব তথ্য কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মো. আজবাহার আলী শেখ। তিনি বলেন, ‘পুলিশ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে। কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ তৎপর আছে।’
সিলেটে জেলা বিএনপির দাবি দলের একেবারে তৃণমূল কর্মীর বাড়িতেও পুলিশ প্রতিদিন দুই তিনবার করে যাচ্ছে। তাদের না পেয়ে বাড়ির লোকজনকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘আবার বাড়ি রাস্তার পাশে হওয়ায় পুলিশ প্রতিদিন তিন-চারবার করে বাসায় খুঁজতে যাচ্ছে। বাসায় থাকতে পারছি না। আমার আয়ের বড় উৎস কৃষিখাত। সবজি ফলিয়েছি কষ্ট করে। বিক্রির উপযুক্ত হয়ে গেছে সেগুলো। গ্রেপ্তার এড়াতে মাঠে যেতে পারছি না। ফলে পরিচর্যার অভাবে সবজি মাঠেই নষ্ট হচ্ছে।’
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশ মামলার পর মামলা দিচ্ছে। আমাদের আইন সেলের হিসেব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সিলেটে ২৫টি মামলা দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার কর্মীকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে নেতাকর্মীদের বাড়ির বাইরে থাকতে হচ্ছে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশ প্রতিদিন নেতাকর্মীদের বাড়ি হানা দিচ্ছে। তিন চারবার করে যাচ্ছে। গ্রামের একেবারে তৃণমূলের কর্মীটিও রেহাই পাচ্ছে না। বাসাবাড়িতে গিয়ে নেতাকর্মীদের না পেয়ে পরিবারের নারীদের হুমকি ধামকি, রূঢ় আচরণ করছে। বিএনপি কর্মীর বাসায় গিয়ে তাকে না পেলে পুরুষ সদস্য যাকে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যেন দেশের বৃহৎ দলটির সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি দলের সভাপতি হয়েও গত ২৯ অক্টোবরের পর থেকে বাড়িতে থাকতে পারছি না। আমাদের উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদিরও বাড়ি ছাড়া। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিএনপি করছি বলে খুব খারাপ কাজ করছি। তাদের আচরণে মনে হচ্ছে আমরা চোরচোট্টা।
সিলেট জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সিলেট জেলা পুলিশ ৭টি মামলা করেছে। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে ৯৯ জনকে। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৮ জনকে।
এসব তথ্য কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন সিলেট জেলা পুলিশের মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা (সহকারী পুলিশ সুপার) মো. সম্রাট তালুকদার। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৭ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৮ জনকে।
বিএনপির পক্ষ থেকে হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) শেখ মো. সেলিম অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি, জানমালের ওপর হুমকি স্বরূপ, যারা টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ, পেট্রল বোমা, বাসে আগুন দেওয়া-এসবের সঙ্গে জড়িত তাদের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’ হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হয়রানি হচ্ছে এরকম কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। অভিযোগ পাওয়া গেলে সেটা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আমরা দেখব।