Friday, November 8, 2024
Homeইসলামভালো নেই মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন,দায়িত্ব বেশি বেতন কম

ভালো নেই মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন,দায়িত্ব বেশি বেতন কম

 

ইমাম-মুয়াজ্জিনের পক্ষে ইয়াছিন আলী খান,

মসজিদ একটি ধর্মীয় শিল্পকর্ম। আমাদের বাংলাদেশে ধর্মীয় এ শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ১০ লাখ ইমাম-মুয়াজ্জিন। ধর্মীয় সমস্যা সমাধানে জনসাধারণ মাঝে মধ্যে ইমামদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইমাম-মুয়াজ্জিনকে সমাজের বাইরে চিন্তা করা হয়।

 

ইমাম-মুয়াজ্জিনরা ইবাদত হিসাবে এ পেশায় নিজেকে যুক্ত করে রেখেছেন। বিশ্বনবি (সা.) এবং তাঁর সাহাবিরা এ দায়িত্ব পালন করেছেন। সে কারণে তারা আত্মমর্যাদার সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন আমি অমুক মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিন। কিন্তু সমস্যা হলো যোগ্য ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগের প্রতি ধর্মানুরাগী মুসলমানদের চাহিদা যেমন আছে, তেমনি প্রয়োজন ছিল ইমাম-মুয়াজ্জিনের চাহিদা ও প্রয়োজন বিবেচনায় নেওয়া। বাস্তবে তা করা হয় না।

 

সমাজে ইমাম-মুয়াজ্জিন সম্মানী ব্যক্তি। দেশের শহর ও শহরতলীর মসজিদগুলোতে ফ্রি খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে খুবই যত্নসহকারে মসজিদের দায়িত্ব পালন করছেন ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা। তাদের বেতনের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। স্বল্প বেতনের পাশাপাশি দিন-রাত মসজিদে ডিউটি করেও নেই মানসিক স্বস্তি। প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকতে হয় মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে।

 

আর্থিক ও মানসিক অসহায়ত্বের কারণে ধর্মীয় এ দায়িত্ব পালনে পূর্ণ একাগ্রতা হারিয়ে ফেলার কথা বলে থাকেন অনেক মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। সময়ের পরিক্রমায় সবকিছু পরিবর্তন হলেও বদলাচ্ছে না দেশের প্রায় ১০ লাখ ইমাম-মুয়াজ্জিনের ভাগ্য। আমাদের বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য যেভাবে হু হু করে বাড়ছে এবং সেই চাহিদা বিবেচনায় সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন-ভাতায় সামঞ্জস্যতা-ভারসাম্যতা রক্ষা করা হলেও কেবল মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা অবহেলায় থাকছেন যুগ যুগ ধরে।

 

পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাব অনটনে দিনাতিপাত করছেন বেশিরভাগ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন। এটাকে ভাগ্যের স্বাভাবিক ফয়সালা বলেই নীরবে সয়ে যাচ্ছেন সব ধরনের যন্ত্রণা।

 

বাংলাদেশের ৬৪ জেলার গ্রামাঞ্চলের মসজিদগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রায় মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেতন কাঠামো গড়ে ৫/১০ হাজার টাকার অনেক নিচে। যা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এর মধ্যে সন্তানদের লেখাপড়া করানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে পরিবার নিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হয়। গ্রামাঞ্চলের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা বলেছেন, বেতনে স্বল্পতার পাশাপাশি মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকেও নানাভাবে মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়। এমনকি অধিকাংশ মসজিদ কমিটির অনেক সদস্য আছেন, যারা ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না।

 

সব সময় ভুল ধরার পেছনে লেগে থাকেন। সামান্য বিষয় নিয়ে অনেক ইমাম-মুয়াজ্জিনকে চাকরি হারাতে হয় বলে নিয়মিত অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ ইমাম বিশ্বাস করেন ইমামতি ও মুয়াজ্জিনি কোনো গতানুগতিক চাকরি নয়। তারা এ পেশাটাকে ইসলামের খেদমত হিসাবে গ্রহণ করছেন। এক্ষেত্রে যদিও অভাব-অনটনে জীবন কাটে তবু তারা মনে করেন, ইমামতি ও মুয়াজ্জিনি পেশাকে চাকরি বলাটা ভুল।

 

এটা আল্লাহর ইবাদত ও মসজিদের খেদমত। কষ্ট হলেও খেদমত করতে এসে টাকা-পয়সার হিসাব করাটা কেমন কেমন লাগে! এ কষ্টের কথা একমাত্র আল্লাহকেই বলা উচিত। দেশের বেশিরভাগ মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা অসহায় জীবনযাপন করলেও এ বিষয়ে কথা বলা আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে বিধায় কথা বলতে চান না। এসব বিষয়ে সচেতন মহলের গভীরভাবে ভাবা উচিত।

 

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির (২০০৯-১০ অর্থবছরে) চালানো এক জরিপে দেখা যায়, সারা দেশে জামে মসজিদের সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার ৩৯৯টি। ২০১৭ সালে এসে জামে মসজিদের এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ। আর এসব মসজিদে একজন ইমামের পাশাপাশি কোনো কোনো মসজিদে একাধিক ইমামও (সানি ইমাম) রয়েছেন। মসজিদগুলোতে রয়েছেন একজন করে মুয়াজ্জিন ও খাদেম।

 

ফলে সারা দেশে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব আর খাদেমের সংখ্যা প্রায় দশ লাখ হবে বলে ধারণা দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির এক সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়, মসজিদগুলোতে ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগ, ছুটিছাঁটা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির জন্য কোনো নীতিমালা নেই। মসজিদ পরিচালনায় ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কোনো বিধিবিধান নেই। ফলে যার যেমন খুশি মসজিদ চালাচ্ছেন, যখন খুশি ইমাম-মুয়াজ্জিন বিদায় করছে মসজিদ কমিটি। এতে নিরীহ ইমাম-মুয়াজ্জিন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

 

তাদের নালিশ করার কোনো জয়গা নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, মসজিদ পরিচালনা, পরিচালনা নীতি, কমিটি, মসজিদের পদবিসহ বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয় ২০০৬ সালের ১৫ নভেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে। এ প্রজ্ঞাপন প্রকাশের ১৯ বছর হলেও আজ পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের ভাগ্য বদলানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

 

দেশের শীর্ষ আলেমরা বলেন, যদি ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সার্বিকভাবে উপযুক্ত সম্মানী দেওয়া হয় তবে তারা মানসিক অস্থিরতা ও আর্থিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। ইমামদের যথাযথ সম্মান দিলে দেশ ও জাতি সবাই উপকৃত হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য যেভাবে হু হু করে বাড়ছে এবং সেই চাহিদা বিবেচনায় সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন-ভাতায় সামঞ্জস্যতা-ভারসাম্যতা রক্ষা করা হলেও কেবল মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা অবহেলায় থাকছেন যুগ যুগ ধরে।

 

এদিকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি, বাংলাদেশের মসজিদ পরিচালনা কমিটির মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অনুপ্রবেশ ঘটে যাওয়ায় ইমামরা জাতীয় কোনো ইস্যুতে কথা বলতে ভয় পান বা চুপ থাকেন এবং এ দুর্বলতার কারণেই অনেকে বিভ্রান্ত হন। মসজিদ কমিটিতে থাকা রাজনৈতিক দলের সদস্যরা তাদের মতের লোককে সমর্থন করে থাকেন।

 

সব সময় সব এলাকার মসজিদে তাদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। মতের বিরুদ্ধে গেলে চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। ইমামদের চাকরি হারানোর ভয়ে থাকতে হয় সব সময়। তাই সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ কমিটিগুলোকে পলিটিক্সের বাইরে রাখা জরুরি বলে মনে করেন আলেমরা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments