ইসলামী জীবনঃ
অতিথির সমাদর করা ঈমানদারের ভূষণ। আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলরাও অতিথিপরায়ণ ছিলেন। যেমন পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর আতিথিয়েতার বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ‘তোমার কাছে ইবরাহিমের সম্মানিত মেহমানদের খবর পৌঁছেছে কি? যখন তারা তার কাছে এলো এবং বলল—সালাম, উত্তরে সেও বলল—সালাম। এরা তো অপরিচিত লোক।
অতঃপর সে দ্রুত চুপিসারে নিজ পরিবারবর্গের কাছে গেল এবং একটি মোটাতাজা গোবাছুর (ভাজা) নিয়ে এলো।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ২৪-২৬)
আমাদের নবীজি (সা.)-ও অতিথিপরায়ণ ছিলেন। নবীজি (সা.) প্রথম জিবরাঈল (আ.)-এর সাক্ষাৎ পেয়ে ভীত হলে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে খাদিজা (রা.) বলেন, কখনো নয়। আপনি সুসংবাদ নিন।
আল্লাহর শপথ, আল্লাহ কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়দের খোঁজখবর নেন, সত্য কথা বলেন, সহায়হীন লোকদের বোঝা লাঘব করে দেন, নিঃস্ব লোকদের উপার্জন করে দেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং হকের পথে আসা বিপদাপদে পতিত লোকদের সাহায্য করে থাকেন। (বুখারি, হাদিস : ৪৯৫৩)
এখানে খাদিজা (রা.) নবীজি (সা.)-এর যে কয়টি গুণ উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে একটি হলো মেহমানদারি, যা মানুষের ওপর আল্লাহর রহমত বৃদ্ধি করে। এ জন্য প্রিয় নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতদের মেহমানের সমাদর করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, …যে ব্যক্তি আল্লাহর আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন মেহমানদের সমাদর করে। (মুসলিম, হাদিস : ৭৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা দয়াময় রহমানের ইবাদত করো, (মানুষকে) খাবার খাওয়াও এবং সালামের অধিক প্রচলন ঘটাও, তবেই নিরাপদে জান্নাতে যেতে পারবে। (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৫৫)
নবীজির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাসীরা ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। আরবের মুহারিব গোত্র খুবই উগ্র ছিল। কট্টর ইসলামবিরোধী ছিল।
ইসলামের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে যখন মানুষ দলে দলে মদিনায় আসতে লাগল, তখন মুহারিব গোত্রেরও ১০ জন লোক মদিনায় এলো। রাসুল (সা.) তাদের অভ্যর্থনা-আপ্যায়নের জন্য বেলাল (রা.)-কে দায়িত্ব দেন। সকাল-বিকাল তাদের আহারের সুব্যবস্থা করেন। এতে তারা মুগ্ধ-বিস্মিত হলো এবং ইসলাম গ্রহণ করে নিজ দেশে ফিরে গেল। (আসাহহুস সিয়ার, পৃষ্ঠা : ৪৪৪)
মেহমানের সমাদর আল্লাহ তাআলার এত প্রিয় যে এক সাহাবি দম্পতির মেহমানদারি দেখে মহান আল্লাহ হেসেছিলেন এবং আয়াত নাজিল করেছিলেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে—
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক (ক্ষুধার্ত) ব্যক্তি নবী (সা.)-এর খেদমতে এলো। তিনি খাদ্যদ্রব্য কিছু আছে কি না তা জানার জন্য তাঁর সহধর্মিণীদের কাছে লোক পাঠালেন। তাঁরা জানালেন, আমাদের কাছে পানি ছাড়া অন্য কিছুই নেই। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কে আছ যে এই (ক্ষুধার্ত) ব্যক্তিকে মেহমান হিসেবে নিয়ে নিজের সঙ্গে খাওয়াতে পার? তখন জনৈক আনসারি সাহাবি আবু তালহা (রা.) বলেন, আমি (পারব)। এই বলে তিনি মেহমানকে নিয়ে (বাড়িতে) গেলেন এবং স্ত্রীকে বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মেহমানকে সম্মান করো। স্ত্রী বলেন, বাচ্চাদের আহার্য ব্যতীত আমাদের ঘরে অন্য কিছুই নেই। আনসারি বললেন, তুমি আহার প্রস্তুত করো এবং বাতি জ্বালাও। বাচ্চারা খাবার চাইলে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দাও। (স্বামীর কথা অনুযায়ী) তিনি বাতি জ্বালালেন, বাচ্চাদের ঘুম পাড়ালেন এবং সামান্য খাবার যা তৈরি ছিল তা উপস্থিত করলেন। (তারপর মেহমানসহ তাঁরা খেতে বসলেন) বাতি ঠিক করার বাহানা করে স্ত্রী উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়ই অন্ধকারের মধ্যে আহার করার মতো শব্দ করতে লাগলেন এবং মেহমানকে বোঝাতে লাগলেন যে তাঁরাও সঙ্গে খাচ্ছেন। তাঁরা উভয়েই (বাচ্চারাসহ) সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে গেলেন, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তোমাদের গত রাতের কার্যকলাপ দেখে হেসে দিয়েছেন অথবা বলেছেন খুশি হয়েছেন এবং এ আয়াত নাজিল করেছেন। (আনসারদের অন্যতম গুণ হলো এই) : ‘তারা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের ওপর অন্যদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। আর যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৯)
তাই অভাব-অনটন ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় মেহমানের সমাদর করার চেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে মেহমানের সমাদর করার তাওফিক দান করুন।