নিজস্ব প্রতিবেদক,
গত কয়েক বছর থেকে দেশের চা-শিল্পে টানাপড়েন চলছে। কৃষিভিত্তিক এই শিল্পটি ইদানীং বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে সঠিক পরিকল্পনা, তদারকি ও পরিচালনার অভাবে। গত বছর দেশে চা-এর উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০৩ মিলিয়ন কেজি ছিল। কিন্তু উত্পাদন হয় ৯৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন কেজি।
অবশ্য তার আগের বছর ২০২৩ সালে চা উত্পাদন হয় ১০২ দশমিক ৯২ মিলিয়ন কেজি। যা ছিল দেশের চা-শিল্পের ইতিহাসে রেকর্ড। ‘চা একটি সংবেদনশীল কৃষি পণ্য। এর জন্য প্রয়োজন সুষম আবহাওয়া। এবারও মৌসুমের প্রথমে খরা দেখা দেওয়ায় উত্পাদন হার হ্রাস পায়। পরে অবশ্য জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত যে বৃষ্টি হয় তাতে পুষিয়ে যেতে পারে,’ এই মন্তব্য করে একাধিক চা-বাগান মালিক বলেন, ‘দেশের চা-বাগানগুলো মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।’
বিগত পাঁচ বছর থেকে আলোচিত সিন্ডিকেটের কারণে নিলাম বাজারে চা-এর ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ক্রমাগত লোকসান গুনতে হচ্ছে বাগানগুলোকে। তারা বলেন, ‘চা-বাগানগুলো চিরতরে বন্ধ হওয়ার পথে।’
বাগানগুলোর আর্থিক সংকট দূরীকরণে চার ভাগ থেকে পাঁচ ভাগ হারে ব্যাংক ঝণ প্রদানসহ নানা অসুবিধা দূরীকরণে বাগান মালিকরা চা সংসদদের চেয়ারম্যানের পদক্ষেপ দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তারা চা-শিল্পকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা, সিলেটে একটি নিলাম কেন্দ্র স্থাপন, চা বেশি পরিমাণে রপ্তানি করা, চা-শ্রমিকদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগসহ ১২টি প্রস্তাবনা চা-সংসদের চেয়ারম্যান বরাবরে উত্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে তারা উত্তারাঞ্চলে মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চা-এর উত্পাদনে চা-এর দরপতনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করেছেন চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে।
সিন্ডিকেট :বাগানমালিকরা শঙ্কিত
অন্যদিকে সরকার নিলাম মূল্য প্রতি কেজি চা ২৪৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও। সিন্ডিকেটের তত্পরতায় বাগানমালিক সংশ্লিষ্টরা শঙ্কিত। তারা জানান, এমনিতেই সার কীটনাশক, তেল ইত্যাদির দাম বেড়েছে। এই অবস্থায় চায়ের ইষ্পিত মূল্য পাওয়া না গেলে লোকসান বাড়বে। তারা বলেন, দেশের চা-বাগানগুলোর আদৌ টিকে থাকবে কি না সন্দেহ। ২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত চা-এর উত্পাদন খরচ বেড়েছে ৫৮ দশমিক ৩০ ভাগ। একই সময়ে চায়ের দর বেড়েছে ৯ দশমিক ১৬ ভাগ। দামের তুলনায় উত্পাদন খরচ বেশি হওয়ায় চা-শিল্পের আর্থিক সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাই চা-শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রতি কেজি চায়ের গড় মূল্য ২৫০ টাকায় উন্নীত করতে হবে।
যেন ‘করামিন’ ইনজেকশন দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে
চা-শ্রমিকদের রেশন, বেতন-ভাতা প্রদানসহ নানা বিষয় নিয়ে বাগানমালিকরা চরম সংকটে। সম্প্রতি সিলেটের বুরজান ও মৌলভীবাজারের ফুলতলা চা-বাগান বন্ধ হয়ে পড়লে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তা রক্ষায় পৃথক পরিচালনা কমিটি গঠন করে কোনোরকমে যেন ‘করামিন’ ইনজেকশন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন। ঐ দুটি বাগান পরিচালনায় রয়েছে দুটি কোম্পানি। কোম্পানি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাগান দুটি পরিচালনা করার কথা।
ভূমির মালিকানা দাবি, মোট চা উত্পাদনের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে সিলেট থেকে
যেখানে বাগানগুলোর অস্তিত্ব সংকটে, সেখানে এখন চা-শ্রমিকরা দাবি জানিয়েছেন, তাদেরকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাগানে বসবাসরত ভূমি প্রদান করতে হবে। কর্তৃপক্ষীয় মহল বলে, দেশের সব কটি চা-বাগানের মালিক সরকার। সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক এগুলো ইজারা দিয়েছেন। তাই তাদের পক্ষে কাউকে ভূমি প্রদান করার আইনি ভিত্তি নাই। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবুজ পাহাড় ও ঘন বনভূমির জুড়ে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে চা-বাগান অবস্থিত। চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গল উপজেলা। দেশে চা উত্পাদন মৌসুম জুন থেকে নভেম্বর। চা বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে সমতল ও পাহাড় মিলে চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। এর মধ্যে বেশি চা-বাগান সিলেটে। মোট ১৩৭ টির মধ্যে আবার মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে ৯২টি বাগান। আর বাগানগুলোতে চা-চাষের আওতাধীন ৮৫ হাজার ৫৪১ দশমিক ৬২ একর জমি। দেশের মোট চা উত্পাদনের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে এ অঞ্চল থেকে।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন-সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জিএম শিবলী বলেন, চা-বাগান মালিকদের আন্তরিকতায় প্রতি বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ চা উত্পাদন সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইসমাইল হোসেন জানান, এই ফসলের উত্পাদন বৃদ্ধি ও গুণমান রক্ষায় নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।