নিজস্ব প্রতিবেদক,
দাবি পূরণে কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। বুধবার সকাল ১০টায় কলেজ ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, দ্রুতই ক্লাসে ফিরবেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌনতা নাথ মিশি, চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. হারুন অর রশিদ, প্রিয়াস চন্দ্র দাস এবং দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কায়েস আব্দুল্লাহ জামান।
এর মাধ্যমে সপ্তাহে ছয়দিন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ওয়ার্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল অবকাঠামোগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ, ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (সিএ) ও রেজিস্ট্রার নিয়োগ, সার্জারি, মেডিসিনসহ সকল ক্লিনিক্যাল বিষয়সমূহে যথাযথ ওয়ার্ড বাস্তবায়নের জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ, ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থার ঘাটতি দ্রুত সমাধান, হাসপাতালের কার্যক্রম ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে চালু করা ও হাসপাতালের কার্যক্রম এই সময়ে চালু করতে যে রোডম্যাপ অনুসরণ করা হবে তা স্বচ্ছভাবে উপস্থাপনের দাবিতে টানা ৮দিনে আন্দোলনের সমাপ্তি হলো।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ২২ এপ্রিল কলেজে এবং ঢাকায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে দফায় দফায় আলোচনার মাধ্যমে ওয়ার্ড ও হাসপাতাল এই দুই দাবির তাৎক্ষণিক সমাধান পাওয়া যায়। যেসব সমস্যার সমাধান সময় সাপেক্ষ তার রোডম্যাপ দেওযায় আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশ্বস্ত হয়েছি। এজন্য আমরা সর্বসম্মতিতে আমাদের আন্দোলন কর্মসূচির প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিচ্ছি। তবে ওয়ার্ড যদি রেগুলার মনিটর না হয় এবং হাসপাতালের রোডম্যাপ ফলো না করা হয় তবে আমরা পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচি নিযে মাঠে নামবো।
এসময় যৌক্তিক দাবির আন্দোলনে পাশে থাকার জন্য সাধারণ জনগণ, মেডিকেল কমিউনিটি ও মিডিয়াকে ধন্যবাদ জানান শিক্ষার্থীরা।
সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে ক্লিনিকাল ওয়ার্ড ও হাসপাতাল সুবিধা থেকে বঞ্চিত উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা এর আগেও অনেকবার আমাদের এই যৌক্তিক দাবি কলেজ কর্তৃপক্ষ ও উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরলেও কোনো কার্যকর সমাধান পাইনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক দাবি পূরণে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নেই। সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ এপ্রিল কলেজ ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, ১৬ এপ্রিল শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক অবরোধ করি। এসময় জেলা প্রশাসক মহোদয় ও কলেজ প্রশাসন স্বাস্থ্য সচিবের সাথে আমাদের ভার্চুয়াল মিটিংয়ের ব্যবস্থা করায় আমরা রাস্তা ছেড়ে দেই। স্বাস্থ্য সচিবের সাথে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী দিন ১৭ এপ্রিল ঢাকায় স্বাস্থ্য শিক্ষার মহাপরিচালকের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা অধ্যক্ষ ও শিক্ষক প্রতিনিধিদের উপস্থিতে স্বাস্থ্য শিক্ষার মহাপরিচালক কে আমাদের দাবির বিষযে স্মারকলিপি প্রদান করেন। ১৭ এপ্রিল আমাদের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াম মিয়া’র কাছে স্মারকলিপি প্রদান করি। একই দিনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সুনামগঞ্জ সদরে সাধারণ মানুষের বহুল প্রতিক্ষিত হাসপাতাল চালুর বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির জন্য জনসংযোগ কর্মসূচি পালন করা হয়। ১৮ এপ্রিল আমাদের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষকদের উপস্থিতিতে সিলেটে স্বাস্থ্য সেবা মহাপরিচালক ডা. আবু জাফর’র কাছে আমাদের দাবির বিষয়ে স্মারকলিপি প্রদান করি, একই দিনে শিক্ষার্থীরা শান্তিগঞ্জ উপজেলাতে শান্তিপূর্ণ জনসংযোগ করে।
আমাদের দাবিগুলো নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় এবং আমাদের আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাধ্য হয়েই আমাদের আন্দোলন আরও জোরদার করতে সাধারণ জনগণকে নিয়ে ২০ এপ্রিল সড়ক অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেই উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের কর্মসূচি সম্পর্কে পূর্বেই সাধারণ জনগণ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পরিবহন মালিক সমিতি, আইনজীবী সমিতি ও এলাকার সুশীল সমাজকে অবগত করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণ শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। ২০ এপ্রিল আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের উপর অতর্কিত হামলা ও লাঠিচার্জ করে। এই ন্যাক্কারজনক হামলায় আমাদের ৫৩ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ও আমাদের দাবি নিয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিশ্রুতি না পাওয়ায় আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সকল কাজ কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দেই। ২১ এপ্রিল আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মোস্তাক আহমদ ভূঁইয়া ও অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ আমাদের যৌক্তিক দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করেন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আমাদের দাবিগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলে বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের যৌক্তিক দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করে তা সমাধানের জন্য ২২ এপ্রিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনার ব্যবস্থা করেন। মিটিংয়ে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ডা জিয়াউর রহমান চৌধুরী, সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. আনিসুর রহমান, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, সিভিল সার্জন, সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মোস্তাক আহমেদ ভূঁইয়া, কলেজের সকল শিক্ষকবৃন্দ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। একই দিনে কলেজে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন প্রতিনিধিদের সাথে এবং ঢাকায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সাথে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের দফায় দফায় আলোচনা হয।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের দাবি ছিল- ১৬ জুনের মধ্যে হাসপাতালের আউটডোর, মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনি এই তিনটি ওয়ার্ড চালু এবং ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে হাসপাতালের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে চালু করা ও হাসপাতাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জরুরি ভিত্তিতে একজন পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়াও সপ্তাহে ৬ দিন ওয়ার্ড সুবিধা চালু, কনসাল্টেন্ট নিযোগ ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় আমাদের সপ্তাহে ছয় দিন ওয়ার্ড সুবিধা চালু করা, সদরে শিক্ষার্থীদের জন্য সার্জারি মেডিসিন গাইনি এই তিনটি কনসাল্টেন্ট নিয়োগ ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের যোগদান নিশ্চিত করা হবে উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, ওয়ার্ডে কলেজের শিক্ষকদের উপস্থিত নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই সাথে ট্রান্সপোর্ট সমস্যা সমাধানে তিনটি বাস দ্রুততম সময়ে দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে। হাসপাতালের বিষয়ে পিডব্লিউডি প্রতিনিধিরা বলেছেন, তারা আগামী জুনের মধ্যেই হাসপাতালের আউটডোর এবং অক্টোবরের মধ্যে হাসপাতালের কাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ হবে। উপস্থিত স্বাস্থ্য বিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্রুত হাসপাতালের নিযোগ চালুর বিষযে আমাদের আশ্বস্ত করেন। এসময় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সাথে একটি নজরদারি কমিটি (surveillance committee) গঠন করে ওয়ার্ড ও হাসপাতালের কাজ তদারকি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীরা বলেন, গত ২০ এপ্রিল অপ্রত্যাশিতভাবে সেনা সদস্যদের সাথে সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সৃষ্টি হয়। কলেজে উপস্থিত সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় ২০ এপ্রিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই সাথে আমাদের যৌক্তিক দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং আমাদের দাবি পূরণে তাদের করণীয় থাকলে তারা সার্বিকভাবে পাশে থাকার আশ্বাস প্রদান করেন।
এদিকে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের আলোচনায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. মো সায়েদুর রহমান সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রসঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিডির সাথে বৈঠকে বসবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। এছাড়াও কাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে তিনি খোঁজ খবর নিবেন বলে জানিয়েছেন। একইসাথে হাসপাতালে জনবল নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাথে কাজ শুরু করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
ডা. মো সায়েদুর রহমান আরও বলেছেন, রবিবার থেকে কলেজে বাস সার্ভিস চালু হবে। স্থায়ীভাবে বাস কেনার প্রক্রিয়া শুরু করবেন বলেও তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। সদর হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষক নিয়োগ করার ব্যাপারেও একমত হয়েছেন। এসময় শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে একটি স্মারকলিপি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর পাঠানো হয়।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আগামী সোমবার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী হাসপাতাল প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলে এবং সার্বিক পরিস্থতি নিয়ে একটি মিটিংয়ে আয়োজন করবেন, এসময় তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ আমাদের দিবেন বলে জানিয়েছেন।