স্বাস্থ্যসেবা প্রতিদিন,
বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতিতে শুঁটকি মাছ একটি জনপ্রিয় খাদ্য হিসাবে পরিচিত। যদিও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বেশি পরিমাণে শুঁটকি উৎপাদিত হয়, কিন্তু দেশবিদেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শুঁটকি জনপ্রিয় খাবার হিসাবে সমাদৃত হয়ে আসছে। আবার এটি এমন একটি খাদ্য, যা দীর্ঘসময় ধরে সংরক্ষণও করা যায়।
শুঁটকি মাছের বিশেষ রন্ধন পদ্ধতি এবং শুঁটকি মাছের ধরণ এর স্বাদের ভিন্নতা নিয়ে আসে। শুঁটকি মাছ শুধু খেতে সুস্বাদু তা নয়, এর রয়েছে অনেক দরকারি পুষ্টি উপাদান।
১. শুঁটকি একটি উচ্চপ্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। শুঁটকি মাছে প্রথম শ্রেণীর প্রোটিন পাওয়া যায়। তাছাড়া শুঁটকি মাছের প্রোটিনের পরিমাণ তাজা মাছের তুলনায় বেশি। কারণ শুকানোর প্রক্রিয়ায় পানি বেরিয়ে যায় এবং প্রোটিন ঘন হয়ে যায়। শুঁটকি মাছে প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশই প্রোটিন পাওয়া যায়। শরীরের প্রতিটি কোষের প্রোটিন প্রয়োজন, কারণ প্রোটিন দেহের মাংসপেশী গঠন, ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোষের মেরামত করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও প্রোটিনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
২. শুঁটকি মাছের মধ্যে প্রচুর আয়রন থাকে, যা রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরি করে শরীরের কোষে অক্সিজেন পরিবহণ করতে সাহায্য করে। এছাড়া আয়রন শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া দেখা দেয়, যা ক্লান্তি, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট এবং মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
৩. শুঁটকি মাছ ক্যালসিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন ও ঘনত্ব বাড়ায়, যা হাড় ও দাঁত মজবুত করে। তাই শিশুদের হাড়ের বৃদ্ধি ও ঘনত্ব বজায় রাখতে এবং বয়স্কদের অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করতে শুঁটকি মাছ বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৪. শুটকিতে ভালো পরিমাণ ফসফরাস থাকায় এটি আমাদের হাড়, দাঁতের পাশাপাশি ডিএনএ এবং আরএনএ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. শুঁটকি ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের একটি ভালো উৎস। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হার্টের কার্যকারিতা উন্নত করে। শুঁটকি মাছের মধ্যে থাকা এই ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, একাগ্রতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ওমেগা-৩ শরীরে প্রদাহ কমায় এবং আর্থ্রাইটিসের মতো রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
৬. শুঁটকি মাছ ভিটামিন এ, ডি এবং বি-কমপ্লেক্স ভিটামিনের একটি সমৃদ্ধ উৎস। ভিটামিন এ চোখের দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে রাতের বেলা বা কম আলোতে দেখা সমস্যার সমাধান করে। ভিটামিন ডি শরীরের ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়ক, যা হাড়ের মজবুতির জন্য অপরিহার্য।
৭. শুটকিতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পাশাপাশি শুটকিকে থাকা ভিটামিন, মিনারেল ও প্রোটিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে বিভিন্ন সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।
৮. শুঁটকি মাছ প্রাকৃতিকভাবে লবণ এবং পটাশিয়াম সরবরাহ করে, যা শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। লবণ শরীরের বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন পেশী সংকোচন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। পটাশিয়াম শরীরের সেল কার্যক্রম উন্নত করতে এবং হার্টের সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক। তবে যেহেতু শুঁটকি মাছের মধ্যে প্রাকৃতিক লবণ থাকে, তাই অতিরিক্ত লবণ যোগ করে শুঁটকি মাছ না খাওয়াই উচিত। কারণ অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৯. শুঁটকি মাছ সহজপাচ্য হওয়ার কারণে এটি হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। এর মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক এনজাইম এবং প্রোটিন পাচনতন্ত্রের জন্য উপকারী। শুঁটকি মাছ খেলে পেটে হালকা অনুভূতি হয় এবং অতিরিক্ত গ্যাস বা ফোলাভাবের ঝুঁকি কমে। তাই যাদের হজমে সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য শুঁটকি মাছ খাওয়া একটি ভালো সমাধান হতে পারে। তবে অতিরিক্ত তেল মসলা দিয়ে রান্না করার ফলে অনেক সময় শুঁটকি মাছ এসিডিটি বা বদহজমের কারণ হতে পারে।
শুঁটকি যেমন উপকারী ঠিক তেমনি শুঁটকি যদি ভালো মানের না হয়, তাহলে তা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেমন পোকা ধরা ঠেকাতে শুটকিতে রাসায়নিক বা কীটনাশক মেশানো হয়ে থাকে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। শুটকিতে অতিরিক্ত লবণ থাকলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে, যা থেকে পরে হৃদ্রোগ এবং স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগও হতে পারে। তাই বাজার থেকে শুঁটকি মাছ কেনার সময় এর গন্ধ, রং এবং টেক্সচার পরীক্ষা করে বুঝে কিনতে হবে।
যারা দীর্ঘমেয়াদি কিডনির রোগে ভুগছেন ও যাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিড বাড়তি থাকে তাদের শুঁটকি খেতে নিষেধ করা হয়। তাছাড়া সাধারণ মানুষের জন্যও প্রতিদিন শুঁটকি না খাওয়াই ভালো, খেতেও হবে পরিমিত।