বিশেষ প্রতিনিধি,
২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজে পাস করেছে ৪৯৮ জন শিক্ষার্থী। এ বছর পরীক্ষার্থী ছিল ৫০৫ জন। অথচ এই কলেজটিতে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ৩০০ আসনের অনুমোদন রয়েছে। অনুমোদনের চেয়ে অতিরিক্ত ২০৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে।
শুধু ২০২৪ সালেই এ ঘটনা ঘটেনি। ২০১৪ সাল থেকেই এভাবে প্রতিবছর অনুমোদনের চেয়ে ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থী বেশি ভর্তি করা হচ্ছে এমসি কলেজে। ৩০০ আসনের এই কলেজটিতে কীভাবে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০০ থেকে ৫০০ জন হয়, তা জানলে রীতিমতো অবাকই হবেন সবাই। আর এর আড়ালে যে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয় সেটার চিত্র দেখলে চোখ কপালে উঠবে।
গত এক দশক ধরেই এমসি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিকে কেন্দ্র করে এমন বাণিজ্য চললেও নীরব কলেজ প্রশাসন। খোঁদ সিলেট শিক্ষাবোর্ডও ‘অন্ধ’। কারণ এসবের নেপথ্য কারিগর এমসি কলেজ ছাত্রলীগ। রয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন নেতাও।
কাগজের অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ভর্তি হওয়া কোনো শিক্ষার্থীই মুখ খুলতে নারাজ। অবশ্য বিষয়টি স্বীকার করেছে এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিবছর অতিরিক্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তি বিষয়ে সিলেট শিক্ষোবোর্ডের অনুমোদন রয়েছে। ছাড়পত্রের মাধ্যমে তাদেরকে ভর্তি করা হয়। সেটি সিলেট শিক্ষাবোর্ড অনুমোদন দেয়। অনুমোদনের বাইরে কোনো শিক্ষার্থীকে ছাড়পত্রের মাধ্যমে ভর্তি করা হয় না।
যেভাবে হয় টিসি বাণিজ্য,
প্রতিবছর সিলেট শিক্ষাবোর্ডের অন্যান্য কলেজের মতো এমসি কলেজেও একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথম ধাপেই ৩০০ আসন পূর্ণ হয়ে যায়। তারপর কলেজে গিয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন শিক্ষার্থীরা। ভর্তিকৃত ৩০০ শিক্ষার্থীকে নিয়ে যথারীতি পাঠদানও শুরু করে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করার তিন-চার মাসের মধ্যে ছাড়পত্রের মাধ্যমে কলেজ পরিবর্তনের আবেদন আহ্বান করে সিলেট শিক্ষাবোর্ড। ছাড়পত্রের নোটিশে স্পষ্ট উল্লেখ থাকে, একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিকৃত কলেজ থেকে যে কলেজে যেতে ইচ্ছুক, সেই কলেজে অনুরূপ গ্রুপ, বিষয়, ভার্সন, ন্যূনতম জিপিএ ও আসন খালি থাকা সাপেক্ষেই আবেদন করা যাবে।
যেহেতু এমসি কলেজে আসন খালি থাকে না, তাই ছাড়পত্রের মাধ্যমে এমসি কলেজে অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ পান না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেই সুযোগ ঠিকই মেলে, যদি কেউ হাঁটতে পারেন সেই পথে। দীর্ঘ দিন ধরে সেই পথ তৈরি করে রেখেছে এমসি কলেজ ছাত্রলীগ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসএসসিতে জিপিএ-৫ ধারী যেসকল শিক্ষার্থীরা অনলাইনে আবেদন করেও এমসি কলেজে ভর্তির সুযোগ পান না, তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেন এমসি কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা। অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নিজ থেকেও আবার যোগাযোগ করেন তাদের সঙ্গে। এরপর শুরু হয় তাদের সঙ্গে চুক্তি। ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকাও চুক্তি হয় শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সঙ্গে। এরপর ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ছাত্রলীগ। পরে সেটি দেওয়া হয় কলেজ অধ্যক্ষের কাছে। পরবর্তীতে অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে সিলেট শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাড়পত্রের মাধ্যমে এসব শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন নেওয়া হয়। এভাবে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার টিসি বাণিজ্য করে আসছিল ছাত্রলীগ।
এমসি কলেজের একাধিক সূত্র বলছে, ছাড়পত্রের মাধ্যমে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দিতে বাধ্য হন কলেজের অধ্যক্ষ। এই সুযোগ না দিলে অধ্যক্ষকে চেয়ার থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতো ছাত্রলীগ। বাধ্য হয়ে চেয়ার ধরে রাখতে ছাত্রলীগের কথামতো কাজ করতে হতো অধ্যক্ষকে। এমন ঘটনার ভুক্তভোগী এমসি কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ আবুল আনাম মো. রিয়াজও।
সূত্র বলছে, চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রাবাসে পানি ও ইতিহাস বিভাগে শিক্ষক সংকট নিরসনসহ তিন দফা দাবিতে অধ্যক্ষ আবুল আনাম মো. রিয়াজকে অবরুদ্ধ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এদিন বিকেল ৪টা থেকে কার্যালয়ে তালা দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় তাকে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে আন্দোলন হলেও এর পেছনে ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
কাগজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ ঘটনার নেপথ্যে ছিল ছাত্রলীগের টিসি বাণিজ্য। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের (সরকারি কলেজ-২) উপসচিব কাজি মো. আবদুর রহমান বিপিএএ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান অধ্যাপক আবুল আনাম মো. রিয়াজ। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর ছাড়পত্রের মাধ্যমে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেন। এতে ছাত্রলীগের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় ভিন্নখাতে অভিযোগ তুলে অধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। যার পেছনে ছিল ছাত্রলীগ।
অবশ্য এ ঘটনার কথা এখনও মুখ খুলে বলতে সাহস পাচ্ছেন না কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল আনাম মো. রিয়াজ। তবে তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ছাড়পত্রের মাধ্যমে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে না। এর আগে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও সেটার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।’
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে ৪২১ জন পরীক্ষার্থী। পাস করেছে ৪১৬ জন। ২০১৭ সালে এসব শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। অর্থাৎ ২০১৭ সালে অতিরিক্ত ১২১ জনকে ভর্তি করা হয়েছে ছাড়পত্রের মাধ্যমে। যারা ২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। ওই বছর ফেল করে ৫ জন শিক্ষার্থী।
পরের বছর ২০২০ সালে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী ৫ জন যোগ করলে মোট পরীক্ষার্থী হওয়ার কথা ৩০৫ জন। কিন্তু ওই বছর পরীক্ষার্থী ছিল ৪৩২ জন। অর্থাৎ অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ছিল ১২৭ জন। ওই বছর কোনো শিক্ষার্থী ফেল করেনি।
২০২১ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ৪০৬ জন। এ বছর অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১০৬ জন। ওই বছর ফেল করে দুইজন শিক্ষার্থী। এভাবে প্রতিবছরই অনুমোদিত আসনের চেয়ে অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থী বেশি ভর্তি করা হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৫০৫ জন পরীক্ষার্থী এইচএসসিতে অংশ নিয়েছে। যা ছিল বিগত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আগের বছরের অনিয়মিত পরীক্ষার্থী ২ জন বাদ দিলে ২০২৪ সালে ২০৩ জন শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করা হয়েছে। তারা ২০২১ সালে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল।
যা বলছে ছাত্রলীগ ও কর্তৃপক্ষ,
গত ৫ আগস্টের পর থেকে উধাও এমসি কলেজ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তবে এ বিষয়ে জানতে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে এমসি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি দেলওয়ার হোসেন রাহি বলেন, ‘এমসি কলেজ সিলেটের মধ্যে সেরা কলেজ। সবার চাহিদা থাকে এই কলেজে ভর্তি হওয়ার। টিসি (ছাড়পত্র) একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়। কেউ ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগযোগ করলে আমাদের কী করার আছে। যারা কলেজে ভর্তি হয় কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষাবোর্ড থেকে অনুমোদন নিয়ে আসে। এটা ব্যক্তিগত কিছু না। বোর্ড কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করেন কীভাবে শিক্ষার্থী বাড়ে?’
আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে ছাড়পত্রের মাধ্যমে ভর্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার পিছে লেগে লাভ নেই। যারা অপরাধ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তাদের খোঁজ নেন। আমি দেশে আছি এখনো। আমি হাজার কোটি টাকা আয় করি নাই।’
এমসি কলেজ অধ্যক্ষ আবুল আনাম মো. রিয়াজ বলেন, প্রতিবছর ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগসহ কিছু প্রভাবশালী মানুষের অনুরোধ থাকে। কিন্তু আসন কম থাকায় সবাইকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া যায় না। তবে যারা বেশি অনুরোধ করে থাকেন, তাদের শিক্ষার্থীদের টিসির মাধ্যমে কলেজ পরিবর্তন করে ভর্তি করা হয়। তবে টিসির মাধ্যমে আসা সকল শিক্ষার্থীর অনুমোদন সিলেট বোর্ড দিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ড. সৈয়দ মোয়াজ্জম হুসেন বলেন, কলেজের অধ্যক্ষ আমাদেরকে অনুরোধ করেন কিছু বাড়তি আসন বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। কারণ অধ্যক্ষদের কাছে অনেক সময় অনেকের অনুরোধ থাকে, সেই প্রেক্ষিতে তারা বোর্ডের কাছে আবেদন করেন অতিরিক্ত আসনের।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা তার অনুমোদন দিয়ে থাকি। তাছাড়া কিছু কলেজ অবকাঠামো এবং জনবলের দিক দিয়ে যদি সক্ষমতা থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে অতিরিক্ত আসন বরাদ্দ দিয়ে থাকি।