Sunday, November 24, 2024
Homeসিলেট বিভাগসিলেটের টেংরাটিলার দুর্ঘটনা দেশের অর্থনীতির জন্য ‘কাল’

সিলেটের টেংরাটিলার দুর্ঘটনা দেশের অর্থনীতির জন্য ‘কাল’

বিশেষ প্রতিনিধি:::

টেংরাটিলা সুনামগঞ্জের ছাতকে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র। এটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)-এর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সনে সর্বপ্রথম দেশের শিল্পখাতে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয় এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে। তবে এই গ্যাসক্ষেত্রে ২০০৩ সালে নাইকো-বাপেক্স যৌথ উদ্যোগে একটি চুক্তির মাধ্যমে নাইকোকে গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কূপ খনন শুরু হলে গ্যাসক্ষেত্রটিতে বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের ফলে গ্যাসক্ষেত্র এবং তার আশপাশের এলাকায় পরিবেশ ও জনজীবনের ব্যাপক ক্ষতি করে। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটে।

জানা গেছে, এ ঘটনায় নাইকোকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দাবি করে সরকার। বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ী নয় উল্লেখ করে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটে’ (ইকসিড) সালিশি মোকদ্দমা করে নাইকো। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে একটি সমীক্ষা চালায় বাপেক্স। এর পরিপ্রেক্ষিতে নাইকোর কাছে বাপেক্স ১১ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং বাংলাদেশ সরকার ৮৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইকসিডে নালিশ জানায়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালটি নাইকোকে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায় দেন। এতে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৮ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল। যদিও এ ক্ষতিপূরণ এখনো পাওয়া যায়নি।

জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় ২০০১ থেকে ২০১০ সময়কালে বিদেশী কোম্পানিগুলোর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস অনুসন্ধানবিমুখতা তৈরি হয়। একই সঙ্গে সেই সময় জ্বালানি খাতের উন্নয়নে রোডম্যাপ ও সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া বিভিন্ন সময় ক্ষমতার পালাবদলও এ খাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণে পদে পদে বাধা তৈরি করে।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে ২০০৯ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশের গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির বড় পরিবর্তন দেখা যায়। ২০০১ সালে গ্যাসের বার্ষিক সরবরাহ ছিল প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিউবিক ফুট (বিসিএফ)। পর্যায়ক্রমে তা বেড়ে ২০০৮ সালে উন্নীত হয় ৫৯৬ বিসিএফে। ২০০১ সালে গ্যাস খাতে জাতীয় গ্রিডে পেট্রোবাংলার একক সরবরাহ ছিল ২৯৩ বিসিএফ এবং ২০০৮ সালে তা ৩২৫ বিসিএফে উন্নীত হয়। এ সময় বিদেশী তেল-গ্যাস কোম্পানির জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ ৭৭ বিসিএফ থেকে ২৭১ বিসিএফে উঠে যায়। গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর (আইওসি) কাছে কর পরিশোধের পরিমাণও সেই সময় বেড়ে যায় বলে এডিবির ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে আসে।

দেশের গ্যাস খাতের উন্নয়নে ‘গ্যাস সেক্টর রিফর্ম রোডম্যাপ’ (জিএসআরআর) তৈরি করা হয়। ওই রোডম্যাপে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একটি পরিকল্পনা ছিল। সেখানে দেশের গ্যাস খাতের অবকাঠামো, বিশেষত গ্যাস অনুসন্ধান, বিদেশী বিনিয়োগ, গ্যাস খাতে বেসরকারি অর্থায়ন, পাইপলাইন নির্মাণ ও কোম্পানি গঠনের নানা উদ্যোগ ছিল। কিন্তু এসব পরিকল্পনার বেশির ভাগই ওই সময় বাস্তবায়ন করা যায়নি।

দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পিএসসির (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) আওতায় ২০০৮ সালে অফশোরের দুটি ব্লকে দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। বঙ্গোপসাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থা কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি হয়। নতুন এ চুক্তি অনুসারে ওই দুটি ব্লক থেকে আহরিত তেল ও গ্যাসের ৮০ শতাংশ মালিকানা পাবে কনোকো-ফিলিপস। চুক্তিতে আরো বলা হয়, সরকারি সংস্থা পেট্রোবাংলা বা বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি সংস্থা তা কিনতে রাজি না হলে কনোকো-ফিলিপস সেটা বিদেশে রফতানি করতে পারবে। যদিও এতে বড় কোনো গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি।

দেশের গ্যাস রফতানি হবে—এমন বিষয় সামনে এলে দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। নামমাত্র মূল্যে গ্যাস কিনে বিদেশী কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা অনেকের মধ্যে ছিল। এমনকি এসব কাজের পেছনে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সহযোগিতা ছিল বলে সেই সময় অভিযোগ তোলে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি।

২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে গ্যাসের অনুসন্ধানে তেমন কোনো চেষ্টা হয়নি। গত এক দশকের মধ্যে ২০০৪ সালে বাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়। স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্স এ গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করলেও বর্তমানে উন্নয়ন করে এটি পরিচালনা করছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি তাল্লো। এ গ্যাস ক্ষেত্রে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ পাওয়া যায়। বর্তমানে সেটি উৎপাদনে রয়েছে। তবে গ্যাসের সরবরাহে বড় অগ্রগতির পেছনে মূলত কাজ করেছে শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র। এ গ্যাস ক্ষেত্র উৎপাদনে এলে গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যায়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘বিবিয়ানা উৎপাদনে আসার আগে পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহ ছিল অ্যাভারেজ। ২০০৭ সালের মার্চে বিবিয়ানা উৎপাদনে আসে। গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যায়। ওই সময় বিবিয়ানা থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেও কয়েক বছরের মধ্যে তা ৭০০ মিলিয়নে উন্নীত হয়। এর মধ্যে দেশের স্থলভাগে ও সমুদ্রে বিদেশী কোম্পানি দ্বারা গ্যাস অনুসন্ধানে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। ২০০৮ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সময়স্বল্পতার কারণে সেটি আর করা যায়নি। গ্যাস অনুসন্ধানে বিএনপি সরকারের তৎপরতা ছিল ন্যূনতম। তারা রিজার্ভ প্রাক্কলন এবং গ্যাস ব্যবহারের জন্য দুটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছিল সেই সময়। সেই কমিটির সুপারিশ কখনই বাস্তবায়ন হয়নি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments